শরদিন্দু সকৌতুক অথচ শান্ত গলায় বললেন, মনে না থাকলে আজ আমি তোমায় হাওড়া স্টেশনে চিনতে পারলাম কী করে?
নীহার যেন একথাটা ভেবে দেখেননি আগে। সামান্য থতমত খেয়ে গেলেন। তারপর হেসে বললেন, থাক, ও বড়াই আর কোরো না। তুমি আমায় চেনার আগেই আমি তোমায় খুঁজে নিয়েছি।
শরদিন্দু মৃদু হেসে বললেন, তোমার সেই পুরনো অভ্যেস আজও আছে নীহার। এখনও তুমি তোমারটা আগে দেখবে। বেশ, তাই হল। তুমিই আমায় আগে খুঁজে নিয়েছ, আমি তোমায় পরে চিনেছি। ..খুশি হলে তো?
নীহার নীরব হয়ে গেলেন। তাঁর চোখের দৃষ্টি স্নান, বিমর্ষ হয়ে গেল। অনেকক্ষণ পরে নিশ্বাস ফেলে বললেন, কে কাকে আগে চিনেছে সে ঝগড়া আর আমি করব না গো। তুমি ছেলেটাকে নিয়ে আমার কাছে এসেছ, এতকাল পরে, এতেই আমি খুশি।
.
০৫.
দোতলার বারান্দায় বসে শরদিন্দু কিছুক্ষণ বিশ্রাম করলেন; তারপর ওপরে তেতলায় নিজের ঘরে চলে গেলেন। নীহার গেলেন গা ধুতে; গা ধুয়ে পুজোয় বসবেন। তনুশ্যাম বসে থাকল। তারা চোখের ডাক্তারের কাছে গিয়েছিল বিকেলে, ফিরতে ফিরতে সন্ধে হয়ে গিয়েছে।
দোতলার বারান্দায় এই বসবার জায়গাটুকুতে তনু দিনের বেশির ভাগ সময়টাই আজ কাটিয়ে দিল। সকালে অনেকটা বেলা পর্যন্ত বসে বসে কথা বলেছে, কাগজ দেখেছে, বই পড়েছে খানিকটা। বারান্দার রেলিংয়ের ওপর বসানো কাঠের পাল্লা আর শার্সি বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বন্ধ হয়ে আসছিল, এখন কিন্তু সবই প্রায় খোলা, বাতাস আসছে, মাথার ওপর পাখাও চলছে।
হাত কয়েক দূরে খাবার টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে রিনি কিছু একটা ইস্ত্রি করছিল। ইস্ত্রি শেষ হলে সাজসরঞ্জাম নিয়ে সে তার ঘরের দিকে চলে গেল; সামান্য পরে ফিরে এসে তনুর মুখোমুখি দাঁড়াল।
একেবারে চুপটি করে বসে আছ যে–? রিনি শুধোল; একবার পার্ক স্ট্রিট গিয়েই হাঁপিয়ে পড়লে!
তনু রিনিকে দেখতে দেখতে বলল, না। চোখ দেখাবার পর মাথা ধরে যায়।
রিনি রগড় করে বলল, শির দরদ?
তনু হেসে ফেলে বলল, আমি তোমাদের কলকাতার বাঙালিদের চেয়ে খারাপ বাংলা বলি না।
তা দেখতেই পাচ্ছি। রিনি সোফার ওপর বসে পড়ল।
তনু রিনির হাসিভরা মুখ, ঝকঝকে চোখ, লতাপাতা করা ছাপা শাড়িটা দেখতে দেখতে তার বাঙালিত্ব প্রমাণ করার জন্যই যেন বলল, আমাদের ওখানে বাঙালি অনেক আছে। কলেজে তিন চার জন। গভর্নমেন্ট সারভিসে আছে আট দশ জন। বিজনেস আছে বাঙালির, সেলস-এজেন্ট কত আসে।
রিনি আগের মতোই মুখ করে বলল, তোমাদের ওখানে মানে পুরো মধ্যপ্রদেশ তো?
তনু সামান্য জোরেই হেসে ফেলল। বলার কিছু নেই। রিনি আজ সকাল থেকেই তার খুঁত ধরে তাকে খেপাবার চেষ্টা করছে। দু-চারটে শব্দ বা দু-চারটে কথায় কিছু হিন্দুস্থানি টান থেকে গেলে দোষের যে কী আছে তনু বুঝতে পারছেনা। রিনি যে নিজে চিঠিকে চিটি বলে তাতে কোনও দোষ নেই। আজ দুপুরে খাবার সময় টেবিলে বাবা, নীহারপিসি, রিনি আর তনু এই নিয়ে খুব হাসি-রগড়, মজা করেছে।
বাবাই সবচেয়ে মজার কথা বলেছিল। বলেছিল: নীহার তোমার আমার বাড়ি ছিল বিহারে, আমরা হলাম বেহারি বাঙালি, তুমি আমাদের দলে, রিনি হল পুরোপুরি কলকাতা। কলকাতাকে আমরা বলতাম, হালুম-হুঁলুমের দেশ, ওরা খেলুম, গেলুম, শুলুম করেই কাটায়। রিনি এখন বুঝে দেখুক কোন দেশেতে আছে।
তখনকার কথা মনে পড়ায় তনু একটু হাসল। রিনিদের কলকাতা হালুম-হুঁলুমের দেশ তবে!
তনু কিছু বলার আগেই রিনি বলল, মাথা ধরেছে বলে প্যাঁচার মতন মুখ করে বসে আছ! একটা ট্যাবলেট এনে দিই, খেয়ে নাও।
খেতে হবে তনু বলল, কপালটা ফেটে যাচ্ছে।
রিনি ওষুধ আনতে উঠি উঠি ভাব করছিল, তনু বলল, চোখের ডাক্তাররা চোখ নিয়ে টরচার করে, ভীষণ স্ট্রেন হয়।
আমায় চোখ শিখিও না, আমি চোখের ডাক্তারের মেয়ে।
জানি, তনু হাসল, শুনেছি আমি।
তা তোমার চোখের কথা গুপ্তসাহেব কী বললেন?
আমায় কিছু বলেননি। বাবার সঙ্গে কীসব কথা হয়েছে আসবার সময় ট্যাক্সিতে বাবা আর পিসি কথা বলছিল। মালুম হল, কমপ্লিকেটেড কেস। কী কী সব টেস্ট করতে হবে।
রিনিরও সেই রকম মনে হল। শরদিন্দুমামা এবং মার দু-একটা কথা শুনে, মুখ-চোখ দেখে তারও মনে হয়েছে, দুজনেই যেন খানিকটা মনমরা। তনুর সত্যিই খুব মাথা ধরেছে, না বেচারি খুব হতাশ হয়ে গেছে–মুখে সেটা বলছে না, রিনি বুঝতে পারল না, তবে চোখ দেখার সময় ডাক্তার যা করে তাতে ভাল চোখও টনটন করে ওঠে। মাথাও ধরে যায়। রিনি তনুর জন্যে মাথাধরার বড়ি আনতে উঠল।
তনু সোফার মধ্যে ডুবে পা টানটান করে বসে থাকল। বারান্দার ওপাশের বাতিটা নিবিয়ে দিয়েছে রিনি, এপাশেরটা জ্বলছে। খোলা শার্সি দিয়ে সামনের বাড়ির সিঁড়ির প্যাসেজটা চোখে পড়ে। বাতি জ্বলছে। চারপাশে একটা কলরব যেন ভেসেই আছে। বেজায় জোরে কোথাও রেডিয়ো বাজছে। রিনি একসময় বাহারি মাছ পুষেছিল, অ্যাকুরিয়ামটা এখন ফাঁকা, একপাশে রাখা আছে, তার মধ্যে কীসের এক গাছ পুঁতে রেখেছে রিনি, পাতাগুলো বাড়ছে বেশ।
রিনি ওষুধ এনে দিল, জলের গ্লাস।
তনু ট্যাবলেটটা খেয়ে ফেলল। পুরো গ্লাস জলও।
রিনি বসে পড়ল। মা পুজো সেরে এসে চা খাবে। তখন তোমার পিসিকে ম্যানেজ করতে পারলে এক কাপ চাও পেতে পারো। মাথা ধরা ছেড়ে যাবে।