নীহার শরদিন্দুকে দেখছিলেন। মুখটি চৌকো ধরনের, গালের চামড়ার টান পাতলা হয়ে আসছে, চোখের তলা কুঁচকে যাচ্ছে, চিবুক বেশ পাতলা। মাথায় পাকা চুলের মাত্রাটাই বেশি। চোখ দুটি অনেক স্তিমিত। গলার চামড়া ঝুলে এসেছে যেন। বয়স হিসেবে শরদিন্দুকে আরও প্রৌঢ় মনে হয়। গলার স্বরটি কিন্তু এখনও ভরাট।
নিশ্বাস ফেলে নীহার বললেন, তুমি পুরুষমানুষ। তোমার অত ভয়-ভাবনা সাজে না। কথাটা বলার পর নীহারের নিজের কাছেই কেমন অর্থহীন শোনাল।
শরদিন্দু মুখ ফিরিয়ে নীহারের দিকে তাকালেন। আমি অনেক সময় তোমার কথা ভাবতুম। লোকে বলত, তুমি খুব বুদ্ধিমতী, বিচক্ষণ, সাংসারিক বোধবুদ্ধি তোমার কম নয়। আজ এখানে এসে তোমাদের দেখে আমি সত্যিই বেশ অবাক হয়েছি। তুমি তো মেয়ে হয়ে একলা বেশ টেনে এনেছ এই সংসার। তোমার সংসারটিও বড় সুন্দর লাগছে।
নীহার কেমন এক মুখ করে সামান্য হাসলেন। বললেন, মেয়েদের কি আর ছটফট করলে চলে গো? আমাদের পা-ছড়িয়ে বসে কাঁদার সময় কই! বলে বাঁ পা আস্তে করে চেয়ারের ওপর তুলে হাঁটু মুড়ে নিলেন। পা ঝুলিয়ে বেশিক্ষণ বসে থাকতে তাঁর কষ্ট হয়, বাঁ হাঁটুতে একবার জল জমেছিল। মৃদু গলায় বললেন, উনি যখন যান তখন আমি বড় একলা, অসহায় হয়ে পড়েছিলুম। হঠাৎই চলে গেলেন, দুদিন আগেও বুঝতে পারিনি। কী যে ব্যাধি পুষছিলেন পেটে, রক্ত পড়তে শুরু করল সকাল থেকে, বিকেলে নিয়ে গেল হাসপাতালে। পরের দিন ভোরে চলে গেলেন। আমার তখন যা অবস্থা–চোখের সামনে শুধু অন্ধকার দেখেছি। ভগবানের পায়ে শুধু মাথা খুঁড়েছি। ওই কচি মেয়ে, সম্বল বলতে এই বাড়িটা, আর সহায় বলতে নিজের কেউ না, বাইরের দু-একজন। কিন্তু বসে বসে কাঁদলে তো দিন চলে না। বুক বেঁধে উঠে দাঁড়িয়েছি। এখন আমার যা ভাবনা ওই মেয়েকে নিয়ে, আর কিছু নয়।
শরদিন্দু স্থির, শান্ত, সস্নেহ দৃষ্টিতে নীহারকে দেখছিলেন।
দুজনেই কিছুক্ষণ আর কথা বলার মতন কিছু পেলেন না। শরদিন্দু সিগারেটের টুকরোটা ছাইদানে ফেলে দিলেন।
নীহারই কথা বললেন আবার, আমাদের ওখানে পালিতবাবুদের বাড়িতে এক সন্ন্যাসী এসেছিল একবার তোমার মনে আছে?
শরদিন্দুর খেয়াল করতে সময় লাগল। খেয়াল হলে মাথা নাড়লেন আস্তে করে।
সেই সাধু আমার হাত দেখে বলেছিলেন, কোনও কালেই আমার মনের শান্তি হবে না, নীহার বললেন।
নীহারের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে শরদিন্দু শুধোলেন, হয়নি?
কোথায় আর হল?
শরদিন্দু নীরব থাকলেন। নীহারের দুর্ভাগ্যই কি সব? তার সৌভাগ্যের দিনে সে কি শান্তি পায়নি? কথাটা পালটে নিয়ে নীহারকে ভরসা দেবার মতন করে বললেন, তোমার দায় তো শেষ হয়ে এসেছে।
ব্যস্ত ভাবে হাত নেড়ে নীহার বললন, বোলো না বোলো না। মেয়েটা আছে আমার গলার সঙ্গে জড়িয়ে। ওর বরাতে কী আছে–সেই ভেবে ভেবে আমার রাত কাটে।
শরদিন্দু নীহারের উদ্বেগটুকু অনুভব করলেন। তারপর হালকা করেই বললেন, তোমার মেয়েকে দেখলে তোমায় খানিকটা বোঝা যায়।
আমায়? নীহার অবাক হয়ে চেয়ে থাকলেন।
ওর বয়সে তুমিও অনেকটা ওই রকম ছিলে।
আমি আবার ওর মতন ছিলাম কোথায়! নীহার আপত্তি জানিয়ে বললেন, আমার চোখমুখ ও পায়নি, ওর বাবারটা পেয়েছে।
শরদিন্দু নরম গলায় হাসলেন। তোমারও পেয়েছে। তোমার গায়ের রং, কোঁকড়ানো চুল, ছিপছিপে গড়ন–সবই দেখছি তোমার মেয়ে পেয়েছে। কথাবার্তা বলার ধরনটাও প্রায় তোমার মতন।
নীহার হেসে ফেললেন। মাথা নেড়ে বললেন, তোমার মাথা খারাপ হয়েছে, আমি ওর মতন ছিলাম না।
শরদিন্দু কোনও প্রত্যুত্তর করলেন না, হাসিমুখে তাকিয়ে থাকলেন। তাঁর মুখের ভাব দেখে মনে হচ্ছিল, নীহার অতীতে কেমন ছিলেন তিনি তা বিলক্ষণ জানেন।
নীহার যেন হঠাৎ কেমন আনমনা হয়ে গিয়েছিলেন। আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকলেন কয়েক পলক, চোখ নামিয়ে শরদিন্দুর দিকে তাকালেন। তারপর আচমকা বললেন, তুমি আমায় ভুলে গেছ।
শরদিন্দুর মুখের ভাব বদলাল না। নীহারের চোখে চোখ রেখে মৃদু গলায় বললেন, ভুলে গিয়েছি?
দুজনেই নীরব। যেন দুজনের মধ্যে দিয়ে কুড়ি বাইশটা বছরের জল গড়িয়ে যাচ্ছিল।
শেষে নীহার বললেন, ভুলে যাওয়া আশ্চর্য কী। কতকাল পরে আবার আমায় দেখলে বলল তো?
তুমিই বলো।
আঠারো উনিশ বছর পরে। কুড়ি বছরই ধরো– নীহার অন্তরঙ্গ গলায় বললেন। তোমাকে আমি শেষবার দেখেছি, শ্যাম তখন বাচ্চা, বছর চার পাঁচ বয়েস। আমি মেয়ে কোলে করে বাপের বাড়ি গিয়েছিলাম, একেবারে কচি তখন রিনি, দাঁত উঠেছে সবে। তুমি শীতের ছুটিতে বাড়ি এসেছিলে। বউদিকেও আমি সেই প্রথম দেখলাম। এসব কি আজকের কথা! আজ রিনির বয়েস কুড়ি হতে চলল, শ্যামের তেইশ-টেইশ হবে। প্রায় দু যুগ পরে আবার আমায় দেখছ। ভুল হওয়ারই তো কথা।
শরদিন্দু বাঁ হাতটা পাতলা চুলের ওপর দিয়ে বুলিয়ে নিচ্ছিলেন। তাঁর চোখের দৃষ্টিতে কেমন এক মমতা জড়ানো। ধীরে ধীরে বললেন, হ্যাঁ, তোমার সঙ্গে সেই আমার শেষ দেখা। দু যুগ বলতে পারো। পুষ্প তখন বেঁচে ছিল। …তারপর অবশ্য দেখাসাক্ষাত আর হয়নি। কিন্তু খবরটবর পেতাম সবই।
নীহার আবার পা নামিয়ে নিলেন। হাঁটুতে সাড়া পাচ্ছেন না, চাপ লেগে যেন অস্বস্তি হচ্ছিল, ব্যথাও করছিল। সরল গলায় বললেন, তা হলে আমি মন্দটা আর কী বলেছি বলো! আমার বিয়ের পর সেই আমায় প্রথম দেখলে, বিয়ের সময় তুমি ছিলে না, তার আগে যা দেখেছ। অতদিনের চেহারা কি তোমার মনে থাকার কথা?