শরদিন্দু রিনির ও শব্দটা শুনলেন, ও মানে শ্যাম। কানে কেমন যেন লাগল তাঁর, দুপুর থেকে সন্ধের মধ্যে শ্যাম আর রিনির সম্পর্ক বেশ হৃদ্য হয়ে উঠেছে।
নীহারও একসময় তাঁকে এই ভাবে ও বলত। শরদিন্দু কেমন স্নিগ্ধ বোধ করলেন।
নীহার মেয়েকে জিজ্ঞেস করলেন, শ্যামকে দুধ-টুধ দিয়েছিস?
দুধ খাবে না। শরবত খাচ্ছে।
দুধ খাবে না কেন?
কে জানে! আমি জানি না।
দুধ খাওয়া নিয়ে তোরা ছেলেমেয়েরা যা করিস বাপু, আমার মাথা গরম হয়ে যায়। রাত্তিরেই খাবে তবে– নীহার বললেন।
শরদিন্দুর কী যেন মনে পড়ে গেল। নীহারের দিকে সকৌতুক চোখে তাকিয়ে বললেন, তোমারও তো দুধ নিয়ে কত বাতিক ছিল।
নীহার বললেন, আমার সঙ্গে ওদের তুলনা কোরো না। ওদের এই বয়সে—
বাধা দিয়ে শরদিন্দু বললেন, আমি কিন্তু তোমার ওই বয়েসের কথাই বলছি। এটা আমার জানার মধ্যে পড়ে কিনা।
নীহার বোধহয় জব্দ হয়ে চুপ করে গেলেন। তাঁর পান-খাওয়া ঠোঁটে রসের সঙ্গে হাসি এসে মিশে গেল।
রিনি হেসে ফেলেছিল। আর দাঁড়াল না। চলে গেল।
শরদিন্দু আস্তে আস্তে শরবত খেতে লাগলেন। তাঁর কয়েকগুচ্ছ পাকা চুল কানের পাশের কপালের ওপর এলোমেলো হয়ে ছিল।
নীহার ধীরে ধীরে পান চিবোচ্ছেন। মাথায় কাপড় নেই। চুলের খোঁপাটা এলো করে জড়ানো।
বসে থাকতে থাকতে নীহার বললেন, তুমি যেন কী বলছিলে?
কীসের? শ্যামের কথা?
না, শ্যামের কথা নয়। শ্যামকে কাল নিয়ে যাই আগে তারপর। …তুমি অন্য কী বলছিলে না? রিটায়ার করে আবার নিজের বাড়ি-টাড়িতে ফিরে গিয়ে বসবে।
ও, হ্যাঁ; বলছিলাম। আমার সেইরকম ইচ্ছে। প্রবাসেই তো জীবনের বারো আনা কেটে গেল। এবার জীবতারা খসে যাবার আগে নিজের জায়গায় ফেরা ভাল। কী বলো? শরদিন্দু পরিহাস করে বললেন।
নীহার জিজ্ঞেস করলেন, বাড়ির এখন খবর কী? তোমার আসা-যাওয়া ছিল বলে তো শুনিনি।
একেবারে ছিল না, তা বোলো না। মা যতদিন বেঁচে ছিল পুজোর ছুটিটা বাড়িতেই কাটাতাম। মা মারা যাবার পর দিদির জন্যে যেতে হত। দিদিও চলে গেল, আমারও আসা-যাওয়া ফুরোল। শরদিন্দু সামান্য থেমে আবার খানিকটা শরবত খেলেন। আমাদের সাধুকে তোমার মনে আছে। সাধুই বাড়িটা দেখাশোনা করত, থাকত। আমি কখনও-সখনও গিয়েছি। গত বছর পুজোতে গিয়েছিলাম। বাড়িটার কড়ি, দেওয়াল-টেওয়াল অনেক নষ্ট হয়েছে। বাগানটুকু জঙ্গল। অল্পসল্প মেরামত করিয়ে এসেছি। সাধুই করাচ্ছে, আমি টাকা-পয়সা পাঠিয়ে দিই। ও থাকতে থাকতে বাড়িটা আবার বাসযোগ্য করিয়ে নিলে আমার ঝঞ্জাট বেঁচে যায়।
নীহার প্রত্যেকটি কথা মন দিয়ে শুনছিলেন। শরদিন্দুদের বাড়ির ছবিটি তাঁর মনে ভাসছিল। আমিও শুনছিলাম, তুমি বাড়িকাড়ি সারাচ্ছ।
আস্তে আস্তে সারিয়ে নিই, আমার তাড়াহুড়োর কোনও দরকার নেই।
ভালই করছ। বাইরে বাইরে আর কতকাল থাকবে!
শরবতের গ্লাসটা রেখে দিলেন শরদিন্দু, বেশ তৃপ্তি পেয়েছেন মনে হল শরবতটুকু খেয়ে। এবার হাত বাড়িয়ে সিগারেটের প্যাকেট, দেশলাই তুলে নিলেন। দেখো নীহার, বুড়ো হয়ে গেলে মানুষের মধ্যে একটা কেমন ভয়-ভয় ভাব হয়। তখন ইচ্ছে করে জানাশোনাদের মধ্যে থাকতে। যাদের চিনি-জানি তাদের মধ্যেই ভরসা খুঁজি। আমি যেখানে চাকরি করেছি এতকাল, সেখানে মাথা গোঁজার একটা ব্যবস্থা করতে পারতাম। অনেকেই বলেছিল। কিন্তু আমার ইচ্ছে হল না। ভালও লাগে না ওভাবে পড়ে থাকতে। তা ছাড়া ছেলেটা? তার কথা ভাবলে দুশ্চিন্তায় রাত্রে ঘুম হয় না। আমার নিজের মানুষ বলতে আর কেউ নেই। তবু নিজের জায়গায় ফিরে আসতে পারলে ছেলেটাকে অন্তত দেখার লোক জুটবে।
নীহার সমস্তই অনুভব করতে পারছিলেন: শরদিন্দুদের দুশ্চিন্তা, উদ্বেগ, দুঃখ। মানুষটিকে সান্ত্বনা ও ভরসা দিতে বড় ইচ্ছে হল, বললেন, তোমার অত দুর্ভাবনা করার কিছু নেই। এখনও তো একেবারে থুথুরে বুড়ো হয়ে যাওনি। হেসেখেলে কুড়িটা বছর কাটিয়ে দিতে পারবে। শ্যামও বড়টি হয়ে গেছে। দু-চার বছরের মধ্যে সে মানুষ হয়ে যাবে। তোমার ভাবনা কী?
শরদিন্দু দেশলাই জ্বেলে সিগারেটটা ধরিয়ে নিলেন। নীহারের দিকে না তাকিয়েই বললেন, আরও কুড়িটা বছর বেঁচে থাকতে বলছ?
নীহার পায়ের দিকের কাপড়টা গুছিয়ে নিতে হেঁট হয়েছিলেন, ঘাড় তুলে বললেন, ওমা, তা কেন থাকবে না! তোমার এমন কী বয়েস হয়েছে বাপু! সত্তর, পঁচাত্তর বছর পর্যন্ত মানুষ বেঁচে থাকে না? বলছ কী তুমি! আমার শ্বশুরমশাই তো আটষট্টি বছর বয়সে গিয়েছেন।
শরদিন্দু নীহারের দিকে তাকালেন। সামান্য অপেক্ষা করে বললেন, বেঁচে থাকার কথা কেউ কি জোর করে বলতে পারে নীহার? তুমি নিজের অবস্থা দেখে বুঝতে পারছ না, সংসারে ওই জিনিসটার সময় বলে কিছু নেই।
নীহার নীরব থাকলেন। জীবনে এই সত্যটা তাঁর অজানা নয়। শরদিন্দুর জীবনেও তেমন দুর্ভাগ্য না ঘটেছে এমন নয়, নীহার যেমন স্বামীকে হারিয়েছেন, শরদিন্দুও হারিয়েছেন স্ত্রীকে। নিজের বেদনা, শরদিন্দুর বেদনা–দুইই যেন নীহারের মধ্যে কেমন পাশাপাশি দুটি ধারার মতন বয়ে যেতে যেতে একসময় একত্রে মিশে যাচ্ছিল।
শরদিন্দু অন্যমনস্কভাবে সিগারেট খেতে খেতে পিঠ হেলিয়ে বসলেন আবার। তিনি যে কোন দিকে তাকিয়ে ছিলেন বোঝা যাচ্ছে না; আকাশের দিকে, নাকি অনেকটা দূরে–যেখানে নারকোল গাছের মাথায় অন্ধকার জমে মেঘের আকার নিয়েছে সেদিকে তাকিয়ে আছেন!