শরদিন্দু সঙ্গে সঙ্গে কোনও জবাব দিলেন না। সামান্য পরে বললেন, তোমার কত বয়েস হল, বলল তো?
নীহার শরদিন্দুর চোখ, মুখ, আলস্যভরা চেহারা, বিশ্রাম উপভোগের হালকা ভাবটা লক্ষ করতে করতে বললেন, তুমিই বলো না। আমি বললে তো বয়সে কমাব।
কেন, কেন?
মেয়েরা যে নিজেদের বয়েস কমিয়েই বলে, নীহার মুচকি হাসলেন।
শরদিন্দু হেসে ফেললেন। তোমার পঞ্চাশ হয়নি। পঞ্চাশ হতে এখনও দেরি আছে দু-চার বছর।
তোমার কি ষাট হয়ে গেল? নীহার কৌতুক করে বললেন।
আমার ফিফটি ফোর চলছে। তোমাতে আমাতে ছ সাত বছরের তফাত।
মেয়েদের বুড়ি হতে বয়েস শুনতে হয় না গো, এবেলার ফল ওবেলায় গলে যায়।
শরদিন্দু নীহারকে দেখলেন। যতটা নীহার বলছে অতটা বুড়ো হয়ে যাবার লক্ষণ তার চেহারায় নেই। এখনও ওর মুখে লাবণ্য আছে, বরং সাংসারিক সুখ-দুঃখের স্পর্শে সে লাবণ্য আরও ঘরোয়া আরও কোমল হয়েছে। তোমার কি গুরু-টুরু আছে?
গুরু–?
দীক্ষা নাওনি?
না, সেভাবে আমার দীক্ষা নেওয়া হয়নি। শ্বশুরমশাইয়ের সঙ্গে রামকৃষ্ণ আশ্রমের অনেকের মেলামেশা ছিল। আশ্রম থেকেই যেটুকু…
ও! শরদিন্দু চেয়ারের মাথার ওপর থেকে হাত দুটো নামিয়ে নিলেন।
নীহার খানিকটা হালকা করেই শুধোলেন, তা তুমি কিছু করো না?
পুজোটুজো? না– মাথা নাড়লেন শরদিন্দু না, আমার ও পাট নেই। ঠাকুরদেবতা নিয়ে বসবার সময় কই?
নীহার ঠাট্টার গলায় বললেন, ছেলেবেলায় তো খুব ঠাকুর ভক্তি ছিল। দুর্গাপূজায় অষ্টমীতে অঞ্জলি দিতে, কালীপুজোয় রাত জেগে বসে থাকতে, সরস্বতীপুজোয় মাতব্বরি করতে। সে সব গেল কোথায়?
শরদিন্দু যেন স্মৃতির কেমন এক স্পর্শ অনুভব করে মুদু হাসলেন। ভক্তি আমার এখনও যে একেবারে নেই নীহার তা নয়, আছে। বারো-চোদ্দো মাইল ঠেঙিয়ে দুর্গাপুজো দেখতে যাই। কিন্তু ঘরবাড়ি ছেড়ে বির্ভুইয়ে থাকতে থাকতে আমাদের সংসারের আচার আচরণ অর্ধেক নষ্ট ঘরে ফেলেছি। আমাদের বাঙালি হিন্দুবাড়িতে মেয়েরা থাকলে তবু একটা আচার-ধর্ম চোখে দেখা যায়। সেসব পাটও চুকেছে আমার। তার ওপর ছেলেটা। ওর জন্যে মাথায় যে কতরকম ভাবনা থাকে। বলতে বলতে শরদিন্দু চুপ করে গেলেন, তাঁর গলার স্বর গাঢ় শোনাচ্ছিল। দীর্ঘ করে নিশ্বাস ফেললেন। সামান্য পরে বললেন, চাকরি-বাকরি শেষ হয়ে এল। আর দু চারটে বছর, তারপর ঘরের ছেলে ঘরে ফিরে এসে ওই ভগবান-টগবান করেই জীবনটা কাটাতে হবে।
নীহার কিছু বললেন না। শরদিন্দুর মনের বারো আনা ছেলের মধ্যে রয়েছে। সারাদিন হয়তো সেই চিন্তাতেই কাটে। বোধহয় এখন ভগবান-টগবানে ভরসাও নষ্ট হয়ে এসেছে।
কাল একবার গুপ্তসাহেবের কাছে যাই, কী বলো? নীহার বললেন।
একটা খবর দিতে হবে না?
কিছু না। আমার সবই বলা কওয়া আছে। কালকেও আমার সঙ্গে টেলিফোনে কথা হয়েছে। আমি বলেছি, তোমরা আজ এসে পৌঁছোচ্ছ। উনি জানেন সব। কাল সকালে রিনিকে দিয়ে না হয় বাড়িতে একটা ফোন করিয়ে দেব।
কখন যেতে হবে?
বিকেলে। সকালে হাসপাতালে থাকেন। বিকেলে ওঁর চেম্বারে যাব। পার্ক স্ট্রিট।
শরদিন্দু অন্যমনস্ক হয়ে ফুলের টব-গাছগুলোর দিকে তাকিয়ে বললেন, উনি তোমাদের খুব জানাশুনো?
হ্যাঁ নীহার ঘাড় হেলালেন, মানুষটি খুব ভাল। রিনির বাবার সিনিয়ার ছিলেন। একই হাসপাতালে ছিলেন একসময়। খুব ভালবাসতেন ওঁকে।
শরদিন্দু কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন, একেই গেরো বলে বুঝলে নীহার, সেই কলকাতায় আসতে হল, আগে যদি আসতুম, তোমার স্বামী থাকতে, কত সাহায্য পেতাম, হয়তো ছেলেটা এতদিনে ভাল হয়ে যেত।
নীহার বললেন, এলে না কেন।
কেন যে শরদিন্দু আসেননি, তা তিনিও জানেন না। তাঁর তো সব জানা ছিল, নীহারের স্বামীর কথা, নীহারের ঠিকানা; এটাও জানতেন ছেলেকে নিয়ে আসতে চাইলে কোনও অনাদর তাঁর হত না। তবু শরদিন্দু আসেননি! সেটা কি অভিমান বশে? ক্ষোভটা দূর করতে পারতেন না? নাকি তাঁর মনে হত, নীহারের স্বামীর কাছে আসায় তাঁর কোনও গ্লানি, আছে? শরদিন্দু, যে কোনও কারণেই হোক, দূরে দূরেই থাকতে চেয়েছিলেন, কাছে আসতে চাননি। নীহার তখনও তাঁর মুখের দিকে তাকিয়ে, যেন জানতে চাইছেন–এলে না কেন?
শরদিন্দু বললেন, তখন যে এরকম অবস্থা ছিল না। ভুগছিল অবশ্য শ্যাম, কিন্তু চোখ খারাপ চোখ খারাপ করে কেটেছে। জেনারেল হেলথ আর চশমার ওপরই নজর ছিল। ওখানকার ডাক্তাররা আমায় কিছু অ্যাডভাইস করেনি। আস্তে আস্তে অন্যরকম দাঁড়িয়ে গেল। তারপর তো কত রকম করলাম। কলকাতায় পেশেন্ট নিয়ে আসা, থাকা, চিকিৎসা করিয়ে ফিরে যাওয়া, এ তো আমাদের পক্ষে সহজ ব্যাপার নয়, এই দেখো না, তোমাকে কবে থেকে লিখছি শীতের শেষাশেষি আসব। বলেছিলাম শীত, আসতে আসতে সামার পড়ে গেল।
রিনি আসছিল। তার পায়ের আওয়াজ হচ্ছিল সিঁড়িতে। বাড়িতে অর্ধেকসময় পায়ে চটি রাখে না রিনি, খালি পায়ে হাঁটতে নাকি তার আরাম লাগে খুব। সাদা ডিশের ওপর শরবতের গ্লাস নিয়ে সে দেখা দিল।
হাত বাড়িয়ে শরদিন্দু শরবত নিলেন। রিনি মার জন্যে পান সেজে এনেছে, নীহারের হাতে পান দিল।
শরদিন্দু রিনিকে বললেন, শরবতে বরফ-উরফ দাওনি তো?
না, রিনির মাথা নাড়ল, খাবেন বরফ? এনে দেব?
না না।
ও বলল, আপনি বরফ-টরফ খান না, গলা ধরে যায়।