পার্কে এসে রিনি দেখল, বসার জায়গা কোথাও নেই। ছোট পার্ক। ঘাসের চিহ্নও বড় একটা দেখা।
যাচ্ছে না। রিনি হাঁটতে হাঁটতে এক জায়গায় এসে দাঁড়াল। বসবে? দরকার নেই বসে, যা ধুলো।
তনু বলল, তোমাদের কলকাতায় ঘাস নেই।
রিনি টপ করে বলল, আমাদের কলকাতায় গোরুঘোড়া কম।
তনু প্রথমটায় বোঝেনি, পরে বুঝল। বুঝে জোরে হেসে উঠল। আমি যদি বলি, বেশি। বেশি বলেই এই হাল।
রিনি আর জবাব দিতে পারল না। মার শ্যামচাঁদ একেবারে নেহাত গাধা নয়। বুদ্ধি ধরে।
তনু এর মধ্যে কখন চকোলেটটা ভেঙে ফেলেছে। রিনির হাতে আধখানা গুঁজে দিয়ে, নিজে বাকি আধখানা মুখে দিল।
ঠিক এমন সময় একটা বাচ্চা মতন ছেলে বেলফুলের মালা বেচতে সামনে এসে দাঁড়াল। রিনি মাথার চুলে মালা জড়ানো তেমন পছন্দ করে না, সেরকম কোনও সুযোগও তার আজ নেই, তবু কী মনে করে একটা মালা কিনে হাতব্যাগের মধ্যে রেখে দিল।
পার্কের বাইরে এসে রাস্তা পেরোবার সময় রিনি আবার যমুনাকে দেখল। রিকশায় বসে আছে, পাশে যেন একটা অবাঙালি লোক। রিকশাটা ঠুনঠুন করে ঘন্টা বাজিয়ে চলে গেল। রিনি অবাক হয়ে রিকশার পেছনটা দেখতে দেখতে রাস্তা পেরিয়ে এল।
.
০৪.
তেতলায় ঘরের সামনে ছাদটুকুতে শরদিন্দু বসেছিলেন। আকাশটা খুব পরিষ্কার, চারদিক জুড়ে তারা ফুটে আছে। শরদিন্দুর সামনে কিছু টবের গাছ, ফুল নেই, পাতাই চোখে পড়ে। সিঁড়ির দিকের বাতিটা জ্বলছিল। তার সামান্য আলো ছাদের অন্ধকারে পাতলা ভাবে মিশে আছে।
রিনি খানিকটা আগে ছাদে ছিল। শরদিন্দু তার সঙ্গে কথা বলছিলেন। তনুশ্যাম ছাদের আলসের কাছে দাঁড়িয়ে আশপাশের বাড়ি, দুরের নারকোল গাছ, আকাশ দেখছিল। মাঝে মাঝে বাবা এবং রিনির কথাবার্তা তার কানে আসছিল। বাবা যে খুব গম্ভীর মানুষ তা নয়, কিন্তু কলেজে বাবাকে বেশ গম্ভীর, ভারিক্কি মনে হয়, বাড়িতে বাবা অনেক হালকা। তবু তনু বুঝতে পারছিল, বাবা রিনির সঙ্গে গল্প করার সময় আরও হাসিখুশি মজার মানুষ হয়ে যাচ্ছিল। বাবা যেসব গল্প করছিল, তার অর্ধেকই পুরনো গল্প, নিজেদের বাড়িঘরের গল্প, নীহারপিসির গল্প। তনুর সঙ্গে বাবা বড় একটা এসব গল্প করে না। নীহারপিসি কেমন করে একবার নাকের মধ্যে সেফটিপিন ঢুকিয়ে ফেলেছিল, ডাক্তারখানায় নিয়ে গিয়ে তবে সেটা বার করা গেল: কবে যেন এক সাধু এসে পিসির মুঠোয় ছাই দিয়ে হাতের রুলি খুলে নিয়ে পালিয়েছিল–এইসব গল্প। রিনি যে কতটা অবাক হচ্ছিল কে জানে, মাঝে মাঝে খিলখিল করে হেসে উঠছিল। তনুর মনে হল, রিনি এসব গল্পের বেশিটাই জানে। সে প্রায়ই বাবাকে বলছিল: এটা আমি জানি, ও গল্প আমি শুনেছি। নিজেই কোনও কোনও কথার খেই ধরিয়ে দিচ্ছিল। শেষে তনু ছাদ থেকে নেমে গেল।
রিনি গেল আরও খানিকটা পরে, নীহার ওপরে আসার পর। নীহার ছাদে এসে মেয়েকে বললেন, রিনি, তোর মামাকে একটু শরবত করে এনে দে। আর শ্যামকে জিজ্ঞেস কর, শরবত খাবে, না এখন দুধ খাবে খানিকটা। যদি দুধ খায়, ওভালটিন দিয়ে দিবি।
মনে মনে রিনি একটা সংলাপ সঙ্গে সঙ্গে ভেবে নিল। নীচে নেমে মার শ্যামকে সে বলবে: এই যে আসুন খোকাবাবু, মা আপনাকে দুধ খাইয়ে দিতে বললেন। কথাটা মনে করে নিজের মনেই রিনি হেসে ফেলল।
হাসিটা নীহার দেখতে পেয়েছিলেন। মেয়ের দিকে তাকিয়ে বললেন, হাসছিস যে?
রিনি চট করে বলে ফেলল, না, মামার জন্যেও দুধ দিয়ে আসি বরং।
শরদিন্দু তাড়াতাড়ি বললেন, না দুধ নয়। দুধ আমি একবারই খাই, রাত্রে। তুমি আমায় বরং শরবতই করে দাও। সন্ধেবেলায় আমি ইশবগুলের শরবতই খাই লেবু আর মিছরি দিয়ে। …সে পরে হবে, আজ এমনি শরবত খাই।
রিনি চলে গেল।
শরদিন্দু বললেন, তুমি নাকি পুজোপাঠ করতে বসেছিলে?
নীহার গিয়েছিলেন জলের ট্যাঙ্কটার দিকে। রিনির ভিজে শাড়িটা বাতাসে জাপটে গিয়েছিল। তারে-মেলা শাড়িটা ছড়িয়ে দিলেন ভাল করে। সন্ধেবেলায় গা ধোয়ার অভ্যেসটা মেয়ের গেল না, বিকেলে গা ধুয়ে নিলে ক্ষতি কীসের! অনেক বলেও মেয়েকে এই অভ্যেস ছাড়ানো গেল না। গরম-ঠাণ্ডায় মাসের মধ্যে কুড়িদিন ওর গলা খুসখুস, টনসিল ব্যথা লেগে আছে। একসময় গানের গলা করেছিল চমৎকার, বেশ মিষ্টি, আজকাল সে-পাটও তুলে দিয়েছে। কী বলবেন আর মেয়েকে! নিজের মরজিতে ও চলে। একেবারে বাপের মতন। এই গরম বাতিক এখন চলল। খুব বাড়াবাড়ি করে বর্ষা নামার পর বাতিকটা ঘুচবে। শাড়ির পাশে ব্লাউজ, টপটপ করে জল পড়ছে এত ভিজে। নীহার জলটা নিংড়ে দিয়ে ফিরে এলেন।
আমায় কিছু বললে? নীহার শুধোলেন।
বলছিলাম, তুমি নাকি পুজোপাঠ করছ আজকাল?
তা একটু করছি বইকি। বুড়ি হয়ে গেলাম, এখনও যদি না করি, তবে আর কবে করব? নীহার মৃদু হাসলেন।
নীহারের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে শরদিন্দু দুহাত মাথার ওপর তুলে ক্যাম্বিসের চেয়ারের মাথায় রাখলেন। তুমি বুড়ি হয়ে গেলে? শরদিন্দু যেন সস্নেহে, এবং সকৌতুকে হাসলেন।
শরদিন্দুর মুখোমুখি বেতের চেয়ার ছিল একটা; পাশে মোড়া। নারান সন্ধের মুখে বাইরে বের করে রেখে গেছে সব। বেতের ছোট টেবিলে শরদিন্দুর চশমার খাপ, সিগারেট, দেশলাই, ছাইদান।
নীহার বেতের চেয়ারটায় বসলেন। বুড়ি হতে আমার কিছু বাকি দেখছ নাকি?