রিনি।
কোথায় গিয়েছিলি?
এই একটু কাজে– যমুনা বলল, তাকে কেমন চঞ্চল, বিব্রত দেখাচ্ছিল। রিনিকে এড়িয়ে যেতে পারলেই যেন বাঁচে।
রিনি যমুনার এই বিব্রতভাব বুঝতে পারছিল না। অথচ ওটা এমনই যে চোখে না পড়ে যায় না। যমুনার সাজপোশাকটাও রিনির কাছে দৃষ্টিকটু লাগছিল। গলায় পাথরের মালা, হাতে একগাদা প্লাস্টিকের চুড়ি, চোখে বড় করে পেনসিল টেনেছে, মাথার চুলে ফোলানো খোঁপা। শাড়িটাও খুব বাহারে।
যমুনার সঙ্গে দু-একটা কথা বলার ইচ্ছে থাকলেও তার হাবভাব দেখে রিনি কিছু বলতে পারছিল না।
আমি যাই রে যমুনা পাশ কাটাবার জন্যে ব্যস্ত হল খুব। তারপর জবাবের জন্যে দাঁড়াল না, চলে গেল।
রিনি বেশ অবাক হল। যমুনাকে দেড় মাসের মধ্যে আর দেখেনি রিনি। মিল্ক বুথে চাকরি করত যমুনা, ছেড়ে দিয়েছে। কলেজ তো অনেক আগেই ছেড়েছে। ওর বাড়িতে নানারকম গোলমাল যাচ্ছিল রিনি শুনেছে। কিন্তু যমুনাকে আজ যেরকম মনে হল, বাড়ির গোলমালের জন্যে সেরকম হবার কথা নয়।
তনুকে ঘাড় ফিরিয়ে ডাকতে গিয়ে রিনি দেখে তনু নেই। আশেপাশে তাকিয়েও সে তনুকে দেখতে পেল না। আরে! দু পা পিছিয়ে গেল রিনি, ভাল করে দেখল, না, তনুকে দেখা যাচ্ছে না। এখানে এমন কিছু মানুষজনের ভিড় নেই যে, তনুকে দেখা যাবে না। কোথায় গেল তনু? কী আশ্চর্য। আচমকা কেমন এক উদ্বেগ বোধ করল রিনি। পেছনের দিকে না এগিয়ে রিনি তাড়াতাড়ি সামনের দিকে হাঁটতে লাগল। অদ্ভুত ছেলে তো! এরকম মাথা খারাপ ছেলে সে আর দেখেনি, বাবা। এই পেছনে পেছনে আসছিল, পলকের মধ্যে বেপাত্তা! গেল কোথায়? রিনি চারদিকে খুঁজতে খুঁজতে সামনে এগিয়ে চলল, যতদূর সম্ভব দ্রুত পায়ে। তনু যেভাবে রাস্তা হাঁটে তাতে ভরসা করা যায় না। সামনে ট্রামরাস্তা, ডবলডেকার বাস ছুটছে সবসময়, আরও হাজার রকম গাড়িঘোড়া। একটা বিপদ না বাধিয়ে বসে। বিপদের কথা মনে আসতেই রিনির বুক ধক করে উঠল। ট্রামরাস্তার দিকে তাড়াতাড়ি এগিয়ে গেল রিনি৷
হঠাৎ রিনির নজরে পড়ল, বড় রাস্তার মোড়ে, আদ্যিকালের পাকুড়গাছটার তলায় দাঁড়িয়ে তনু খুব বিমুগ্ধচিত্তে কলকাতার সন্ধে দেখছে। ট্রামের আসাযাওয়া, তার চাকার শব্দ, ঘন্টি, ডবলডেকার বাসের আকাশ কাঁপানো গর্জন, প্রাইভেট বাসগুলোর গায়ে কন্ডাক্টরদের দামামা বাজাবার আওয়াজ, মানুষজন, রিকশা–সমস্ত যেন তনুকে সম্মোহিত করে ফেলেছে। ট্রামের মাথায় ফুলকি জ্বলে উঠল, আলো ঝলসে গেল, বাসের পেছনে কালো ধোঁয়া উড়ে রাস্তা অন্ধকার করে দিল, নীলচে রঙের টিউব আলোর বিজ্ঞাপনটা জ্বলে উঠেছে–তনু সবই কৌতূহলের সঙ্গে লক্ষ করছে।
রিনি একেবারে তনুর গায়ের পাশে গিয়ে ডাকল, এই! ডাকবার সময় তার খেয়াল ছিল না যে, সে তনুকে বেশ একটু ঠেলা মেরে দিয়েছে।
তনু তাকাল।
রিনি খানিকটা ধমকের গলায় বলল, বাঃ, অদ্ভুত ছেলে তো! আমি দাঁড়িয়ে আছি, আর তুমি দিব্যি হন হন করে এগিয়ে এলে? আমি এক্কেবারে বোকা। এদিক খুঁজছি, ওদিকে খুঁজছি। আশ্চর্য।
তনু বলল, আমি এইটুকু এগিয়ে এসে দাঁড়ালাম।
এইটুকু? রিনি পাশ ফিরে তারা যেখানে দাঁড়িয়েছিল সেই দূরত্বটা হাতের ইশারায় দেখাল।
তনু বলল, কতটুকু আর?
রিনি ধমক দিল, কতটুকু আর! খুব মজা পেয়েছ। …একটা কিছু হলে তোমার নীহারপিসি আমার গলা কুপিয়ে দিত। খুব হয়েছে, আর বেড়িয়ে দরকার নেই। চলো।
তনু হেসে বললে, আমি সামনের রাস্তা পেরোইনি। তোমার জন্যে দাঁড়িয়েছিলাম।
রিনি তার অভিভাবকত্বর মর্যাদা রেখে বলল, বেশ করেছিলে, এখন ফিরে চলো।
তনুকে নিয়ে রিনি আবার ফিরতে লাগল। তনু মাঝে মাঝে কথা বলছিল। রিনি জবাব দিচ্ছিল না। তেমন। তনুর কথার জবাব তার জানা ছিল না। যেমন, ট্রামের চাকা কতগুলো? ডিজেল ইঞ্জিনের এই ধোঁয়া শহরের বাতাস নষ্ট করছে কেমন করে ইত্যাদি ইত্যাদি।
হাঁটতে হাঁটতে রিনি তাদের বাড়ির কাছাকাছি এসে মনিহারি দোকানটার সামনে থামল। তনুকে বলল, এখানে দাঁড়াও, কোথাও যাবে না; আমি জিনিসগুলো কিনে আনি।
তনু দোকানের সামনে সিঁড়ির নীচে দাঁড়িয়ে থাকল।
জিনিসপত্র কিনে রিনি কোথায় যেন আড়ালে চলে গেল ফোন করতে। ফোন সেরে রাস্তায় নেমে এল, হাতে ব্রাউন পেপারের প্যাকেট।
তনু হাত বাড়াল, আমায় দাও।
থাক।
দাও, আমি নিচ্ছি।
রিনি হঠাৎ তার ডান হাতের মুঠো তনুর হাতের ওপর আলগা করে দিল। তনু দেখল, রিনি তার হাতে পুরু একটা চকোলেট বার ফেলে দিয়েছে। হেসে ফেলল তনু। বলল, চকোলেট আমার খুব ফেভারিট। তুমি জানলে কী করে?
ঘাড় বেঁকিয়ে রিনি বলল, হাত গুনে।
তোমার শেয়ার নাও।
তুমি খাও। তোমার এখনও টফি-চকোলেট খাবার বয়েস রয়েছে।
তোমারও আছে।
তনু হাত বাড়িয়ে রিনির জিনিসপত্রের প্যাকেটটা ততক্ষণে নিয়ে নিয়েছে। রিনির হাতে সামান্য কটা জিনিস।
বাড়ির কাছাকাছি এসে রিনি বলল, পার্কে যাবে? না থাক..দেরি হয়ে যাচ্ছে, মা ভাববে।
তনু বলল, কটা বেজেছে?
রিনি হাতে ঘড়ি পরেনি। তা হলেও তার অনুমান, সাতটা বেজেছে হয়তো। না, রাত নিশ্চয় হয়নি; কিন্তু নুকে নিয়ে রাস্তায় বেরিয়েছে, মা ভাবতে পারে। কী মনে করে রিনি বলল, আচ্ছা চলো, পাঁচ-দশ মিনিটে কী আর হবে–একটা পাক দিয়ে যাই।
রিনিদের বাড়ির সামনে চিলড্রেনস পার্কটা সন্ধের পর পাড়ার বড়দের একটু হাওয়া খাওয়ার জায়গা হয়ে ওঠে। গরমের দিনে অনেকেই এসে বসে থাকে, গল্পগুজব করে। সকালে বুড়োরা চক্করবে।