ফিয়েস্টা?
মেলা, তনু রিনির দিকে তাকাল, কোনও সেন্টস ডে সেলিব্রেট করাকে ফিয়েস্টা বলে। খুব আমোদ আহ্লাদ নাচগান করে ফিয়েস্টা হত। স্পেন-টেনে এখনও হয়। আরও অনেক জায়গায় হয়। ওটা একরকম ফেস্টিভ্যাল। আমাদের ওখানে মেলার মতন হয়, বহুত লোক আসে।
রিনি ঘাড় ঘুরিয়ে বলল, তোমাদের ক্রিশ্চান কলেজ তো?
হ্যাঁ; ওদিকে অনেক জায়গায় মিশনারি স্কুল কলেজ আছে। আমাদেরটা মেথডিস্ট চার্চের হাতে। ছোট কলেজ, মেনলি রেসিডেনসিয়াল।
রিনি আর কিছু বলল না। রাস্তায় মানুষজন কম নয়, সন্ধে হয়ে এল, বাতি-টাতি জ্বলে উঠেছে চারপাশে। আজ গরমটা মাঝামাঝি, তবু পিচের রাস্তার একটা ভাপ যেন অনুভব করা যাচ্ছে এখনও। বাতাসে ধুলোর গন্ধ। শুকনো বকুল গাছটার তলায় ফুটপাথ ঘেঁষে একজোড়া ট্যাক্সি দাঁড়িয়ে আছে। সেজেগুজে মেয়েরা এসে উঠছে, বিয়ে বাড়ি-টাড়িতে যাবে হয়ত।
তনুকে মোটামুটি নজরে রেখে রিনি ফুটপাথ ধরে হাঁটছিল। তনু অন্ধ নয়, তবু অন্ধেরই মতন। একেই তো হাঁদার মতন হাঁটছে, তার চোখ যে কোনদিকে তা খেয়াল করতে পারছে না রিনি। তনু রাস্তাঘাট, আলল, দোকান, বাড়ি, মানুষ কখন যে কোনটা দেখছে, দেখতে দেখতে দাঁড়িয়ে পড়ছে, এর তার গায়ে গিয়ে পড়ে সামলে নিচ্ছে–রিনি বুঝে উঠতে পারছিল না। দু-চারবার রিনিকে ডাকতে হল, সাবধান করতে হল। এরকম মানুষ নিয়ে পথ হাঁটা মুশকিল। তাও তো এই রাস্তায় বাস-টাস চলে না, নয়তো রিনিকে সত্যিসত্যিই তনুর হাত ধরে নিয়ে হাঁটতে হত।
তনু আর একটু হলেই খোঁড়া রাস্তার গর্তে পা ফেলত। রিনি বাঁচিয়ে দিল। তারপর ধমকের গলায় বলল, রাস্তা দেখে হাঁটো। এ তোমার এতোয়ারপুর নয়।
তনু রাস্তা দেখে হাঁটতে লাগল।
এখানটায় জাদা ভিড়।
ভিড় হবে না! সন্ধেবেলায় লোকে বাইরে বেরিয়েছে, মানুষজন অফিস-টফিস থেকে ফিরছে, এখন তো ভিড় হবেই।
সামনেই রিনিদের মনিহারি দোকান। রিনি দোকানের দিকে এগুল না। তনুকে ট্রামরাস্তা পর্যন্ত নিয়ে যাবে বেড়াতে, তারপর ফিরবে। সোজা হাঁটতে লাগল রিনি। রাস্তায় নানা ধরনের জটলা। মোড়ের মাথায় এলে একেবারে দাঁড়িয়ে পড়ছে সে তনুকে নিয়ে, তারপর দুপাশ ভাল করে দেখে রাস্তা পেরোচ্ছে।
একটা আইসক্রিমের দোকান হয়েছে নতুন, সেখানে মেয়েদের খুব ভিড়। যত রাজ্যের পাড়ার মেয়ে বউ ভিড় করে আইসক্রিম খায়। তনুকে কলকাতার একটা আইসক্রিম খাওয়াতে ইচ্ছে হল রিনির। নিজেরও লোভ রয়েছে। কিন্তু ওই মেয়েলি ভিড়ে তনুকে নিয়ে যেতে ইচ্ছে করল না। রিনি তফাত থেকেই চেনা মুখ দেখতে পাচ্ছিল। কেউ ডেকে ফেলতে পারে ভেবে রিনি অন্যমনস্কর ভান করে জায়গাটা পেরিয়ে গেল।
ট্রামরাস্তার কাছাকাছি এসে রিনি সেই ছোঁড়াদের জটলাটাকে দেখতে পেল। চায়ের দোকানের সামনে এই জটলা রিনি তার বাচ্চা বয়স থেকেই দেখছে। কিছু কিছু মুখ অদল বদল হয়েছে এইমাত্র, নয়তো সেই একই ধরনের জটলা। এক দঙ্গল ছেলে নানা ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে, এ ওর গলাটলা জড়িয়ে সারাটা সন্ধে এখানে আড্ডা মারে। রিনি এদের কাউকে কাউকে চেনে, এই পাড়ারই ছেলে, ছেলেবেলায় এক সঙ্গে খেলাধুলোও করেছে। এখনও ওই ছেলেগুলোর বাড়িতে কোনও উৎসব অনুষ্ঠানে রিনিদের যেতে হয় সামাজিকতা রাখতে। রাস্তায় কিন্তু পরস্পরের মধ্যে ব্যবহারটা অচেনার মতন। রিনি ওদিকে খুব কমই তাকায় না তাকিয়েও বুঝতে পারে কারা কারা আছে। ওই দলের মধ্যে একজনকে শুধু পছন্দ করে রিনি, শঙ্করদা। লম্বা চওড়া চেহারা, বছরে তিনবার চুল কাটে, হপ্তায় বার দুই দাড়ি কামায়, গলার আওয়াজ গমগম করছে, রাস্তা কাঁপিয়ে হাসে। আজকাল আবার হাতে বালা পরে, হিপিদের মতন জামা-টামা গায়ে চাপায়। রিনিকে মাঝেমধ্যে ডাকে শঙ্করদা। তবে জটলার মধ্যে ঠিক নয় এই রিনি বলে ডেকে নিজেই বন্ধুদের ভিড় থেকে এগিয়ে আসে, কাছাকাছি এসে দু-চারটে কথা বলে, খবরাখবর নেয়, তারপর অক্লেশে পঁচিশটা পয়সা চেয়ে বসে। রিনি দিয়ে দেয়। আসলে পঁচিশটা পয়সা সেই মুহূর্তে সিগারেট কেনার জন্যে দরকার, বন্ধুদের চা সিগারেট খাইয়ে, কাউকে আবার ট্রামভাড়া বাসভাড়া দিয়ে শঙ্করদার পকেট ফাঁকা। আপাতত রিনির পঁচিশ পয়সায় কটা চারমিনার হবে। তারপর আবার কাউকে ধরবে রাস্তায়। চেনা অচেনা বড় একটা গ্রাহ্য করে না। দিব্যি আছে শঙ্করদা। বলে, বুঝলি রিনি, আমার হচ্ছে মডেস্ট লাইফ, এ মংক ইন মডার্ন সোসাইটি। রিনি ভেঙিয়ে বলে মংকস লাইফ না আর কিছু! তার সাহস হয় না যে বলবে, এ তোমার মাংকিস লাইফ।
জটলাটাকে রিনি তফাতে রেখে চলে যেতে যেতে আড়চোখে একবার দেখে নিল। রিনি এবং তনুকে ওরা দেখছে। কে একজন আর-একজনকে হঠাৎ এমনভাবে তাড়া করলে যে তাড়া-খাওয়া ছোঁড়াটা ছুটে এসে প্রায় রিনিদের পাক খেয়ে আবার ফিরে গেল। এই রগড় বা ইতরামির অর্থ রিনি জানে। শঙ্করদা নিশ্চয় ওখানে নেই, থাকলে ওদের এই সাহস হত না।
বিরক্ত বোধ করে রিনি একটু তাড়াতাড়ি হাঁটতে লাগল। সামান্য এগিয়েই যমুনার সঙ্গে দেখা। যমুনা মুখ নিচু করে একপাশ দিয়ে চলে যাচ্ছিল। হঠাৎ মুখ তুলতেই রিনির সঙ্গে চোখাচোখি হয়ে গেল। দুজনেই থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল।
কী রে? রিনি বলল।