বুঝতে পারছি, রিনি এবার বিনুনিটা হাতের ঝাঁপটায় পিঠের দিকে ঠেলে দিল, ঘাড় নাড়ল। সামান্য, ঠাট্টা করে বললে, নয়তো গায়ে অত বিদ্যের গন্ধ থাকত না।
তনু হাসিমুখে রিনিকে দেখছিল; কোনও কথা বলল না।
রিনি ঘরের মধ্যে দাঁড়িয়েই বুঝতে পারছিল, বিকেল শেষ হয়ে যাচ্ছে, বাইরে আর রোদ-টোদ নেই; ছায়া জমেছে। রাস্তায় বোধহয় বাতি জ্বলে ওঠার সময় হয়ে গেল।
কী মনে করে রিনি বলল, আমি একটু বাইরে যাব। যাবে?
সঙ্গে সঙ্গে তনু মাথা নেড়ে সায় দিল। রিনি বলল, ঠিক আছে; যাবার সময় ডাকব।
রিনি ঘর ছেড়ে চলে এল। নিজের ঘরে আসতে আসতে রিনির হাসি পাচ্ছিল। মার শ্যাম বা শ্যামচাঁদ বেশ ক্যাবলা; হাঁদা টাইপের।
এমন বোকা, গণেশ মার্কা ছেলে, বাবা আর দেখা যায় না। কলকাতার ছেলেদের পাশে একেবারে অচল, গেঁয়ো। তনুকে যদি একবার রিনিদের কলেজের কমনরুমে নিয়ে যাওয়া যায়–মেয়েরা ওকে ঠুকরে ঠুকরেই শেষ করে দেবে। হেনা তো প্রথমেই বলবে, কোথাকার ডেসপ্যাঁচ রে রিনি, অ্যাস আইল্যান্ড থেকে? হেনাটা যেমন ফাজিল, তেমনই চতুর। মেয়েদেরই যা পেছনে লাগে, কাঁদিয়ে ছাড়ে, তা ছেলে! হেনা অদ্ভুত অদ্ভুত কথা তৈরি করে। তার মতন ঠোঁট কাটা মেয়েও বাবা দুটি নেই।
রিনি তাড়াতাড়ি শাড়ি জামাটা বদলে নিতে লাগল। তাকে একবার দোকানে যেতে হবে। মনিহারি দোকানে। কয়েকটা জিনিস আনতে হবে। মা বলেছে। রিনিরও দু একটা জিনিস রয়েছে নিজের। কটা ক্লিপ দরকার, এক ডজন জামার হুক, গরমে ঘাড়ের কাছে ঘামাচি হচ্ছে, বোরেটেড পাউডার নিতে হবে। রিনি একটা ফোন করবে মাধুকে।
শরদিন্দুমামার ছেলেটি বোকাসোকা, হাঁদা যাই হোক এমনিতে কিন্তু বেশ। খুব সরল। রিনির সঙ্গে ভাব হবার পর গড়গড় করে নিজের কথা বলে গেল। তার চোখ ছেলেবেলা থেকেই খারাপ। স্বাস্থ্যও ছিল রোগা। আগে মাথা ধরত খুব, তারপর দূরের জিনিস দেখতে পেত না। আট ন বছর বয়স থেকেই চশমা উঠেছে চোখে। চশমার পাওয়ার বছর বছর এত বেড়ে চলল, সেই সঙ্গে আরও নানা উপসর্গ এমন হয়ে দেখা দিল যে তনুকে হরদম চোখের ডাক্তারের কাছে ছুটতে হত। তার শরীর স্বাস্থ্য নিয়ে মামাও ব্যস্ত হয়ে উঠলেন। সাধারণ স্বাস্থ্যের জন্যে অনেক ওষুধপত্র খেয়েছে তনু; তাতে শরীরে উপকার হলেও চোখের কিছু হয়নি। এক এক ডাক্তার এক এক রকম বলে, চিকিৎসা করে, শেষে চোখ দুটোর যায়-যায় অবস্থা। বাবার সঙ্গে তনু নানা জায়গায় চিকিৎসা করাতে গেছে। কিছু উপকার হয়নি। এক সময় তনুর এমন হয়েছিল যে, বই পর্যন্ত ছোঁয়া বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। চুপচাপ বাড়িতে বসে থাকতে হত। তারপর একজন ডাক্তার সন্দেহ করলেন, উলটোপালটা চিকিৎসার জন্যে চোখ অন্ধ হয়ে যেতে বসেছে। পুরনো সব চিকিৎসা বন্ধ করতে হবে। করে দেখতে হবে চোখ আবার কতটা স্বাভাবিক হয়। তিনি কয়েকটা সাধারণ স্বাস্থ্যের ওষুধ দিলেন, আর চোখের কয়েকটা একসারসাইজ শিখিয়ে দিলেন। তাতে সত্যিই খানিকটা উন্নতি হল। লেখাপড়া ছেড়ে দিতে হয়েছিল তনুকে; আবার সে কলেজ যাতায়াত, পড়াশোনা শুরু করল। কিন্তু তার চোখের ব্যাধিটা যাচ্ছে না, নানারকম কষ্ট হয়, উপসর্গ দেখা দেয়। চোখের দৃষ্টিশক্তি আরও ক্ষীণ হয়ে আসছে। চশমার পাওয়ার বাড়িয়ে আর কতকাল চলবে! বাবা তাই কলকাতায় নিয়ে এসেছেন বড় ডাক্তার-টাক্তার দেখিয়ে চিকিৎসা করাবেন।
রিনি আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে মুখে আলতো করে পাউডার বুলিয়ে গায়ের কাপড়টা ঠিক করে নিল। সে এমন কোথাও যাচ্ছে না, যাবে পাড়ার দোকানে, সাজসজ্জায় ঘটা করল না। এমনিতেও সে সাজগোজের ঘটা বড় একটা করে না। তার ভাল লাগে না তেমন। রিনি ঘরের বাইরে এসে তেতলার সিঁড়ি দিয়ে তরতর করে ওপরে উঠে গেল, মার কাছে। কথা বলে নীচে নেমে এসে আবার মার ঘরে গেল, টাকা পয়সা নিয়ে বাইরে আসতে আসতে ডাকল তনুকে। নিজের ঘরে গিয়ে ব্যাগটা হাতে ঝুলিয়ে দোলাতে দোলাতে বাইরে এসে দেখে তনু বারান্দায় এসে দাঁড়িয়েছে।
সিঁড়ি দিয়ে নীচে নামতে নামতে রিনি হেসে বলল, মা বলল, তোমায় সব সময় চোখে চোখে রাখতে, হাত ধরে নিয়ে যেতে। রিনি একটু বাড়িয়ে বলল অবশ্য।
তনু বলল, কেন?
কলকাতার রাস্তা, গাড়িঘোড়ার ভিড়, কে জানে কোন বিপদ বাধিয়ে বসো৷
কথাটা তনু হালকাভাবেই নিল, বলল, না না, আমি ঠিক আছি।
নীচে নার্সারি স্কুলের ঘরগুলো বন্ধ। সিঁড়িতে আলো জ্বালিয়ে দিয়েছে রিনি৷ নার্সারির পাশে এক চিলতে জমি, একটা দোলনা ঝোলানো রয়েছে। দশ পনেরো পা হেঁটে এসে ছোট কাঠের গেট। তারপর রাস্তা।
রাস্তায় এসে রিনি বলল, আমাদের পাড়াটা কিন্তু এখনও অন্য জায়গার চেয়ে ফাঁকা। খুব হইচই নেই। ফুটপাথ ধরে রিনি হাঁটতে লাগল।
তনু পাশে পাশে হাঁটছিল। বলল, এখানকার বাড়িগুলো খুব ডিসেন্ট। কত উঁচু-উঁচু। আমাদের শহরে ওল্ড টাউনে বিলকুল পুরনো বাড়ি। নিউ টাউনে বিশ-পঁচিশটা ভাল বাড়ি হয়েছে। আমরা থাকি টাউনের ওয়েস্ট সাইডে কলেজ এরিয়ায়। আমাদের দিকটা লোনলি।
রিনি শুধোল, খুব ফাঁকা?
বহুত ফাঁকা। পিচ রোড। দুপাশে গাছ। একটা পুরনো চার্চ আছে। চার্চটার খুব বিউটি। পাহাড়ের মতন উঁচু জমিতে চার্চ, চারদিকে গাছ, নীচে চার্চের তলায় ক্রিসমাসে ফিয়েস্টা হয়। …