হাত ধুয়ে, রিনি তনুর ঘরে গিয়ে দাঁড়াল। তনু জানলার কাছে দাঁড়িয়ে। রাস্তা দেখছে। কিংবা চিলড্রেন পার্কে বাচ্চাকাচ্চাদের খেলাধুলো দেখছে হয়তো। রাস্তায় কিছু দেখে তনুর হাসি পেয়েছে নিশ্চয়।
রিনি সাড়া দিল।
তনু ফিরে তাকাল। এখন আর তার চোখে সেই দিনের বেলার চশমা নেই। রঙিন, চোখ-ঢাকা চশমার বদলে তার চোখে পুরু কাচের সাধারণ চশমা। তনুর চোখ দেখা যাচ্ছিল।
রিনি এমন চোখ করে তাকিয়ে থাকল, যেন জিজ্ঞেস করছিল, ব্যাপার কী? এত হাসির কী হয়েছে?
তনু নিজের থেকেই বলল, কলকাতায় বহুত মজা আছে।
এবার রিনির নিজেরই হাসি পেল: শ্যামের কথাতেও মজা কম নয়। রিনি ভুরু তুলে যেন তনুশ্যামের মাথার মাপটা, কিংবা মগজের পরিমাপটা অনুমান করতে করতে বলল, মজাটা হল কোথায়? সে মজার স্থান কাল-পাত্র জানতে চাইছিল।
তনু জানলা দিয়ে বাইরের দিকটা দেখাল।
রিনি এগিয়ে গিয়ে বাইরে তাকাতে তেমন কিছু দেখতে পেল না। হঠাৎ সে পাখি-ডাকের শব্দ শুনল, তীব্র ডাক। রিনি যেন সঙ্গে সঙ্গে ব্যাপারটা বুঝতে পারল। চিলড্রেন্স পার্কের গেটের সামনে একটা আধ-পাগলা ছেলে মাঝে মাঝে এসে বসে; মুখের সামনে মুঠো পাকিয়ে নানা ধরনের পশুপাখির ডাক ডাকে, রাজ্যের বাচ্চাকাচ্চা তাকে ঘিরে জটলা পাকায়, কেউ বলে, ঘুঘু ডাকো, কেউ বলে, কোকিল ডাকো। ঘুঘু, কোকিল, টিয়া, ময়না, কুকুর, বেড়াল, শেয়াল ডাকতে ডাকতে ছেলেটার দম ফুরিয়ে গেলে সে চুপ করে বসে বসে বিড়ি খায়। বাচ্চাগুলোও অদ্ভুত। তাদের যার যা থাকে, চিনেবাদাম, ডালমুট, চুইং গাম, লেবু লজেন্স–ছেলেটাকে উদার হাতে বিতরণ করে দেয়। দু-চারজন যে জ্বালাতন না করে তাও নয়, তবে সেটা তেমন কিছু না। ওই পাগলা ছেলেটা নাকি শীতকালে সার্কাসের দলে কাজ করেছে।
রিনি বুঝতে পারল, সেই পাগলা ছেলেটার চারপাশে বাচ্চাকাচ্চার ভিড় আর ছেলেটার বিচিত্র সব ডাক শুনে তনুর হাসি পেয়েছে। এতে হাসির যে কী আছে রিনি বুঝল না।
রিনি বলল, ও আধ-পাগলা। জীবজন্তুর ডাক ডাকে।
তনু বলল, পাগলরা খুব ট্যালেন্টেড হয়।
রিনি প্রথমে অবাক হল, তারপর আড়চোখে তনুর দিকে তাকিয়ে থাকল। তার হাসি পাচ্ছিল, কিন্তু হেসে ফেললে তনুকে খোঁচা মেরে ঠাট্টা করা যাবে না বলে হাসিটা চেপে কী বলবে কী বলবে ভাবছিল।
তনু নিজেই বলল, আমাদের ওখানে একটা পাগলা আছে, ফার্স্ট ক্লাস ডিজাইনার।
ডিজাইনার? কী ডিজাইন করে?
সব। তনু কথার শেষে বেশ একটা জোর দিল শব্দে, রিনিরা ঠিক এভাবে সব বলে না। আমাদের কলেজে আগে মালী ছিল বানোয়ারি; এখন পাগলা হয়ে গেছে। গার্ডেনের ডিজাইন করে, গেট ডিজাইন করে, প্যাণ্ডেল বানাতে পারে, দেওয়ালিতে দীপ সাজায়…ভেরি ট্যালেন্টেড।
রিনি চোখ বাঁকা করে খোঁচা মেরে বলল, তোমার ডিজাইনও ও করেছে?
তনু কেমন থমকে গেল। তারপর হেসে ফেলল। হাসতে হাসতে বলল, এ ম্যান ইজ ডিজাইনড অ্যান্ড ডেস্টিনড বাই গড।
রিনি আর হাসতে পারল না। তার অমন ঠাট্টাটা মাঠে মারা যাওয়ায় যেন বিশ্রী লাগছিল।
তনুর সঙ্গে রিনির আলাপ-সালাপ হয়ে গিয়েছে আগেই, নীহার যেমন ওপরে গিয়েছিলেন শরদিন্দুর জিনিসপত্র গুছিয়ে ঘরদোর পরিষ্কার ফাঁকা করে দিতে তেমন মেয়েকে ভার দিয়েছিলেন তনুর জিনিসপত্র গুছিয়ে ঘরটাকে পরিষ্কার করার। অবশ্য নিজেই তিনি মেয়েকে দিয়ে খানিকটা খানিকটা গুছিয়ে দিয়েছিলেন, বাকিটা রিনি সেরে ফেলেছে। তনুর ঘরে লটবহর কমই জমা ছিল।
তনু আর রিনির মধ্যে আলাপটা তখনই ঘটে যায়। তারপর চায়ের সময় রিনি নিজের হাতে চা ঢেলে তনুকে নিয়েছে, দুজনে এক সঙ্গে বসে বসে চা খেয়েছে, গল্প করেছে।
রিনি তনুর চোখের দিকে তাকাল। চা খাবার সময়ই তনু চশমা বদল করে ফেলেছিল; রোদের আলোর ঝাঁঝ কমে গেলে রঙিন চশমাটা পরার কিংবা চোখ ঢেকে রাখার দরকার তার হয় না। তনুর চোখের চারপাশ তার গায়ের রঙের চেয়ে ফরসা। চোখ আড়াল রেখে রেখে এরকম হয়েছে। চামড়াটা পাতলা দেখায় চোখের পাশে, কেমন দুর্বল, বড় বড় চোখ করে সমস্ত পাতা মেলে তনু তাকাতে পারে না, চোখ ছোট করে তাকায়। রিনি লক্ষ করেছে তনুর চোখের পাতা যেন অনেকটা আধবোজা হয়ে থাকে, পলক পড়ে তাড়াতাড়ি। চোখের মণি খানিকটা কটা রঙের। আশ্চর্য লাগে কিন্তু চোখ দুটির দিকে তাকালে-কেমন যেন নরম, সরল, নিরীহ, সকৌতুক। পুরু কাচের চশমার আড়াল থেকেও ওর বিস্ময়, হর্ষ, ছেলেমানুষি স্পষ্ট ধরা পড়ে।
রিনি তনুর চোখ দেখতে দেখতে এবার বলল, বিদ্যের জাহাজ!
জাহাজ?
যা বড় বড় কথা শুনছি।
বড় কথা কেন! বইয়ে এমন কথা পড়তে হয়। কোথাও পড়েছি
থাক, আর শিক্ষা দিতে হবে না। রিনি মজার ভঙ্গি করে হাত নেড়ে বলল, পড়াশোনার কথা শুনলে, আমার জ্বর হয়।
মগর, তুমি কলেজে পড়।
আমি কলেজে যাই বেড়াতে, হুল্লোড় করতে, ফুচকা খেতে।
তনু ছেলেমানুষের মতন কৌতুক বোধ করে হাসছিল। তোমাদের কলেজ কোথায়?
রিনি ঠাট্টা করে বলল, কমনরুমে, গড়িয়াহাটার মোড়ে, চায়ের দোকানে…
তনু কিছু বুঝল, কিছু বুঝল না। হাসতে লাগল।
কী ভেবে রিনি হঠাৎ সদয় হল, বলল, আমাদের কলেজটা কোথায় তুমি বুঝবে না। কলকাতার কী চেন তুমি? এখান থেকে কলেজ খানিকটা দূরে।
তনু বলল, আমাদের কলেজ আর কোয়ার্টার্স পাশাপাশি। আমাদের কলেজের কম্পাউন্ড খুব বড়। পাশেই প্রফেসরদের কোয়ার্টার্স।