স্বস্তির নিশ্বাস ফেলল অবনী। কপাল গাল-গলার ঘাম মুছল। ধীরে সুস্থে সিগারেট ধরাল।
.
এখন আর সে কোনও দুশ্চিন্তা অনুভব করছে না। মাইল সাতেক পথ এখনও তাকে যেতে হবে, এবং রাস্তা অধিকাংশ সময় এই রকম নির্জন ও লোকালয়হীন। তবু অবনী বিন্দুমাত্র উদ্বেগ বোধ করল না। কেননা এর পর রাস্তা ভাল, পাহাড় জঙ্গল নেই, ঝোপঝাড় মাঠঘাট, কোথাও বা বালিয়াড়ির মতন স্তূপ। বড় বড় পাথরের চাঁই ইতস্তত দেখা যাবে। এখানটায়, অবনীর খেয়াল হল, সরকারি নতুন রিজার্ভ ফরেস্ট তৈরি হচ্ছে, গাছপালা লাগিয়েছে বিস্তর, কাঁটাতার দিয়ে ঘিরে রেখেছে। কাছেই নদী।
দূরে আড়াল থেকে যেন হামাগুড়ি দিয়ে একটি আলোর রেখা লাফিয়ে উঠে এল। আলোটা উঁচুনিচু হয়ে নাচতে নাচতে সামনে এগিয়ে আসছিল, তারপর জোরালো হল। অবনী মাঝরাস্তা থেকে ধীরে ধীরে সরে যেতে লাগল। গাড়ি আসছে। দেখতে দেখতে কাছাকাছি এসে গেল। কখনও অবনী,কখনও আগতগাড়ির চালক জোরালো আলো নিবিয়ে এবং জ্বেলে পরস্পরকে যেন দেখে নিল, তারপর আলোর রশ্মি হ্রাস করে পরস্পরকে পাশ কাটিয়ে চলে গেল। পলকের মধ্যেই অবনী বুঝতে পারল, চলে যাওয়া গাড়িটা বড় এবং ভারী, কয়েকজন লোক রয়েছে ভেতরে।
ওরা শহরে যাচ্ছে। পৌঁছতে রাত হয়ে যাবে। হঠাৎ অবনী কেমন নির্বোধের মতন কুণ্ঠিত হাসি হাসল। যারা গেল তাদের মাখারিয়ার পাহাড় জঙ্গল ভেদ করেই যেতে হবে, হামেশাই ওই পথে গাড়ি যায়, তবু আজ অবনী কেন যে অত ভীত ও ত্রস্ত হয়ে উঠল।
আসলে আজ তার কিছু যেন হয়েছিল। কী হয়েছিল? মন খারাপ? হীরালালের মৃত্যুর চিন্তা তাকে ভাবপ্রবণ করে তুলেছিল? সে আহত হয়েছে? বিরক্ত ও বীতশ্রদ্ধ? মৃত্যুর চিন্তা কি গোপনে তাকে ভীত ও উদভ্রান্ত করে তুলেছিল?
.
যে কোনও কারণেই হোক অবনী তখন অতিরিক্ত চঞ্চল ও বিভ্রান্ত হয়েছিল। তার সমস্ত হৃদয় ভারাক্রান্ত ও বিষণ্ণ ছিল। সে ছেলেমানুষের মতন ক্ষুব্ধ হয়ে মৃত্যুর প্রতি আক্রোশ অনুভব করেছিল, এবং উন্মাদের তুল্য মৃত্যুকে তার বিপক্ষ খাড়া করে তার সঙ্গে লড়বার চেষ্টা করছিল। এইসব মিলেমিশে তার স্বাভাবিক বোধ অস্বাভাবিক এত ভীতির সম্মুখীন হয়েছিল। নিজের একাকিত্ব, অসহায়তা, আঘাত, ক্রোধ, বিভ্রান্তি মাখারিয়ার নির্জন নিস্তব্ধ আরণ্যক পরিবেশে ও প্রাকৃতিক দুর্যোগের মধ্যে অত্যন্ত প্রখর হয়ে উঠেছিল।
অবনী ভাবল, শ্মশান দর্শনে যেমন সাময়িক বৈরাগ্য, শ্রাবণের মেঘ দর্শনে মন যেমন ক্ষণিক উদাস হয়–এও সেই রকম। স্বাভাবিক, অথচ অর্থহীন। হীরালালের অপ্রত্যাশিত মৃত্যুর জন্যে বেদনা অনুভব করলেও, অবনী এখন আর সেই উৎপীড়ন বোধ করছিল না। সংসারে এরকম হয়, শত সহস্র হচ্ছে। কেন হচ্ছে, এ প্রশ্ন অবান্তর? জীবনের অনেক প্রশ্নেরই উত্তর থাকে না। সান্ত্বনার জন্যে স্বীকার করে নাও, হীরালালের মৃত্যু দুর্দৈব, দুর্ভাগ্য।
ছেলেমানুষের মতন অবনী শক্ত একটা ঢোঁক গিলল। বাঁ হাতে পকেট থেকে রুমাল বের করে মুখ মুছল।
.
ছড়ানো ছিটোনো পেঁজা পাতলা তুলোর মতন কয়েকটি মেঘ আকাশে, ধীরে ধীরে কোমল জ্যোৎস্না ফুটে উঠল। শিশিরের মতন এই আলো ভিজে এবং মিহি রঙের। অন্ধকারে প্রান্তরগুলি ক্রমশ কেমন পুঞ্জ পুঞ্জ ছায়ার মতো স্পষ্ট হল। দুর্বল রেখায় আঁকা ছবির মতো কাছের দু-একটি অসাড় গ্রামও দেখা যাচ্ছিল। কোথাও জোনাকির মতন আলোর বিন্দু জ্বলছে।
অবনী অনুভব করল, তার মনে এখন আর উদ্বেগের বিন্দুমাত্র অবশিষ্ট নেই। যেন সে কোনও দুরূহ অঙ্কের হিসেব শেষ পর্যন্ত মিলিয়ে নিয়েছে, নিয়ে স্বস্তি অনুভব করছে। একটি বিষণ্ণতা অবশ্য থেকে যাচ্ছে। থাকুক। থাকতে থাকতে কোনওদিন এও চলে যাবে।
মিহি ও আর্দ্র জ্যোৎস্নার মধ্যে শিথিল ভঙ্গিতে গাড়ি চালাতে চালাতে অবনী আরও কিছুটা পথ এগিয়ে এল। সামনে এক জনবসতি, আলো জ্বলছে মিট মিট করে, চালা বাড়ি, শিবমন্দিরও চোখে পড়ছে। আর মাত্র মাইল দুই পথ।
মোড়ের কাছাকাছি আসতে অবনীর চোখে পড়ল লাল রঙের একটি বাস রাস্তার পাশ ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে। এক দল তোক নীচে রাস্তায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। কাছাকাছি একটা দোকান, লণ্ঠন জ্বলছে। কে যেন গলা ছেড়ে কাউকে ডাকছিল।
প্রায় কাছাকাছি আসতে অবনীর চোখে পড়ল, ধুতি-জামা পরা এক ভদ্রলোক রাস্তার প্রায় মাঝামাঝি এসে দাঁড়িয়ে, সামান্য ঝুঁকে তার গাড়ির দিকে তাকিয়ে আছে। অবনী হর্ন দিল। লোকটা আহাম্মকের মতন পথ জুড়ে দাঁড়িয়ে আছে কেন?
পাশ কাটিয়ে চলে যেতে যেতে অবনী দাঁড়াল। লোকটি হাত তুলেছে, দাঁড়াতে বলছে।
গাড়ির পাশে আসতেই অবনী চিনতে পারল মানুষটিকে। সুরেশ্বর। কাছে এসে মুখ বাড়াতে অবনীকেও চিনল সুরেশ্বর। আরে, আপনি?
কী ব্যাপার? অবনী বলল।
আর কী, বাস খারাপ হয়ে গেছে।
অবনী বুঝতে পারল। এরকম দৃশ্য দেখার অভ্যাস তার আছে।
আমি একটু বিপন্ন হয়ে পড়েছি-সুরেশ্বর বিব্রঙ্কণ্ঠে বলল, বাস কখন ঠিক হবে বুঝতে পারছি; চেষ্টা করছে ওরা, তবু…।
কোথায় গিয়েছিলেন?
স্টেশনে। সন্ধের গাড়িতে এক মহিলা এসেছেন। তাঁকে আনতে গিয়েছিলাম।
অবনী সুরেশ্বরের মুখ লক্ষ করার চেষ্টা করল। অবনীকে দেখতে পেয়ে ভদ্রলোকের যেন কিঞ্চিৎ আশার সঞ্চার হয়েছে। অবনী বলল, কোথায় যাবেন? আপনার আশ্রমে? আশ্রম শব্দটা উপেক্ষা ও কৌতুকের স্বরে বলবার চেষ্টা করল অবনী।