নীহার কথা বললেন। শরদিন্দু মুখ ফিরিয়ে দেখলেন, বাক্সর ডালা বন্ধ করেছেন নীহার।
এই বাড়ি নীহার বললেন, বারো আনাই শ্বশুরমশাই শেষ করে গিয়েছিলেন। তখন খরচপত্রও কম ছিল। বাবা নিজে সব জানতেন-টানতেন–তাঁর হাতে না হলে এ বাড়ি আর এমনটি হত না। বাক্সটায় তালা দিয়ে এবার স্যুটকেসটা টেনে নিলেন নীহার। খুললেন না। আমরা আর কতটুকু করেছি। এদিকে এই তেতলার ঘরটা আর ওদিকে দোতলার ছাদটাদ, বাকি কিছু টুকটাক করতে হয়েছে। বাড়িতে ভাড়াটে বসাতে হলে কিছু সুখসুবিধে দেখতে হয়।
তোমাদের ওপাশটায় পুরোটাই ভাড়া?
হ্যাঁ; দুঘর ভাড়াটে থাকে, নীচে আর ওপরে। ওদিকটা দোতলা। আর আমার এদিকে, নীচে গ্যারেজ আর খান-দুই ঘর নিয়ে মিসেস বাগচি নার্সারি স্কুল করেছেন। স্কুল আর কী, কাচ্চাবাচ্চা আসে কিছু পাড়ার, চেঁচামেচি করে, দোলনা দোলে, লাফালাফি করে খানিকটা, তারপর বাড়ি ফিরে যায়। বাড়ির মা মাসিরা দুপুরে জিরোতে পারে নিঝঞ্ঝাটে তারই ব্যবস্থা। নীহার হাসলেন।
শরদিন্দু ঠাট্টা করে বললেন, তুমি নার্সারি স্কুলের প্রেসিডেন্ট?
দূর দূর– নীহার মাথা নেড়ে হাসতে হাসতে উঠে দাঁড়ালেন। কোলের জিনিসগুলো ঘরের আলনায় গুছিয়ে রাখতে রাখতে বললেন, আমার নিজের দিকটায় আর ভাড়াটে বসাবার ইচ্ছে ছিল না। বড় ঝঞ্ঝাট করে। আগে বার-দুই ছিল। বাবা, সে কী বায়নাক্কা। তার ওপর হইচই, গণ্ডগোল। এ তোমার অনেক নির্ঝঞ্ঝাট। সকালের দিকে ঘণ্টা দুই-তিন, তারপর তো ফাঁকা।
কথা বললেন না শরদিন্দু; সিগারেট শেষ হয়ে এসেছিল, ছাইদান খুঁজতে লাগলেন। নীহারের চোখে পড়ল শরদিন্দু এদিক ওদিক তাকাচ্ছেন। নীহার ছাইদান তুলে নিয়ে টিপয়টা শরদিন্দুর চেয়ারের পাশে টেনে দিলেন।
এবার তোমার ওষুধপত্রগুলো বের করে রেখে দিই, নীহার বললেন।
থাক না, আমি নিয়ে নেব।
না না, ঘর জোড়া করে সব পড়ে আছে; পরিষ্কার করে দিলে তুমিও হাঁটাচলা করতে পারবে, দেখতে ভাল লাগবে। নীহার আবার মাটির ওপর বসে পড়লেন।
খানিকটা চুপচাপ থেকে শরদিন্দু বললেন, নীহার তুমি দেখছি বেশ ভাল ভাবেই হালটা ধরতে পেরেছে সংসারের, নয়তো কী যে হত…!
সুটকেসের চাবি বাছতে বাছতে নীহার শরদিন্দুর দিকে তাকালেন। মাথার কাপড় আর তিনি তুলে দেননি, সেই রকমই ঘাড়ের কাছে পড়ে আছে। কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থেকে বললেন, আমি না ধরলে আর কে ধরবে বলো? আমার আর কে ছিল? শ্বশুরমশাইয়ের ওই একটি মাত্র ছেলে, মেয়েটি বিয়ে থা করে তার বরের সঙ্গে সেই যে বিদেশ চলে গেল, আর ফিরল না। ফিরবেও না। আজকাল খোঁজখবরও করে না। বছরে এক আধখানা চিঠিও পাই না। শ্বশুরমশাই মারা যাবার পর আমরাই তো ওর সব ছিলাম। কী দোষ করেছি জানি না সম্পর্কটাও রাখল না আর।
শরদিন্দু অন্যমনস্কভাবে দরজার দিকে তাকিয়ে থাকলেন। কলকাতায় নীহার এতটা একা তাঁর যেন জানা ছিল না। কী মন করে জিজ্ঞেস করলেন, কলকাতায় তোমার শ্বশুরবাড়ির আরও আত্মীয়স্বজন ছিলেন শুনেছিলাম!
একেবারে নিজের কেউ নেই; জ্ঞাতিগোষ্ঠী আছে। আমার এক দেওর আছে, রিনির বাবার মাসতুতো ভাই; আর আছে এক বড় ননদ, ওদের জ্যাঠতুতো দিদি। দেওরটিই যা মাঝে সাঝে এসে খোঁজখবর করে যায়। সে বড় পাগলা। তেমন আপদে বিপদে সেই সম্বল। তবে গজেন ঠাকুরপো থাকে অনেক দুরে, পাতিপুকুরে। যখন তখন আসতে পারে না। ওদের ওদিকে আসা যাওয়াও মুশকিল, নিত্যি গণ্ডগোল। তা ছাড়া মানুষ আজকাল নিজেকে নিয়েই পারে না তো জ্ঞাতিগোষ্ঠী! নীহার কথা বলতে বলতে কাজ শুরু করলেন। ওষুধপত্রর শিশি, হট ওয়াটার ব্যাগ, এটা-সেটা বার করতে লাগলেন।
শরদিন্দু খানিকটা সোজা হয়ে বসলেন। শেষ বেলার এক ফলা আলো মেঝেতে পড়ে আছে, নীহারের বেশ কাছাকাছি। চারপাশে জিনিসপত্র ছড়ান। শরদিন্দু অলস চোখে নীহারকে দেখছিলেন: সব গোছগাছ শেষ না করে নীহার উঠবে না। এখনও যেন তার একরোখা ভাবটা রয়েছে।
ওরা কেউ আসে-টাসে? শরদিন্দু জিজ্ঞেস করলেন, দুলালদা, মণি?
দাদা গত বছর এসেছিল একবার। মণিরা তো দিল্লি চলে গেছে..বাপ-মা যতদিন থাকে ততদিন মেয়েদের বাপের বাড়ির সঙ্গে সম্পর্ক, তারপর সবাই ভুলে যায়, বুঝলে না। মা মারা যাবার পর আমিও আর ওদিকে যাই নি।
শরদিন্দু ঠাট্টা করে বললেন, বাপের বাড়ির দোষ দিয়ো না, নীহার। এই তো আমি এলাম। তোমার বাপের বাড়ির মানুষ।
নীহার ঘাড় ফিরিয়ে তাকালেন। কাঁধ, ঘাড়, গলা খানিকটা মোটা হয়ে যাওয়ায় এখন ভাল করে ঘাড় ফেরাতে পারেন না। সামান্য পাশ ফিরেই বসতে হল। বললেন, তা ঠিক। তবে কত বছর পরে তার হিসেবটা করো।
কত বছর? শরদিন্দু নতুন করে সময়টার হিসেবটা করলেন না। হিসেব করাই আছে। আস্তে করে বললেন, বছর কুড়ি।
তার বেশি ছাড়া কম নয়। তোমায় আমি শেষ দেখেছি, রিনি যখন কোলে। মার কাছে গিয়েছিলাম। তুমি এসেছিলে ছুটিতে। শ্যাম তখন বছর চারেকের। তাই না?
শরদিন্দু অন্যমনস্কভাবে বললেন, হ্যাঁ। তাই হবে।
বউদিকে সেই আমি প্রথম দেখলাম। কী সুন্দর মানুষ ছিল বউদি। কী কপাল তোমার অমন বউটিকে হারালে।
শরদিন্দু নীরব থাকতে থাকতে এক সময় নিশ্বাস ফেলে বললেন, তোমার কপালটাই বা ভাল কোথায়?
রিনির চুল বাঁধা শেষ হয়ে এসেছিল; লম্বা বিনুনিটা বুকের ওপর টেনে নিয়ে সাদা রিবনের ফাঁস জড়াতে জড়াতে বারান্দায় এসেছিল, বেসিনে গিয়ে হাতটা একটু ধুয়ে নেবে, হেয়ার ক্রিমে হাত চটচট করছে। আচমকা ভেতর থেকে হাসি শুনল। বারান্দায় হাসবার মতন কেউ নেই। সরলাদি রান্নাঘরের দিকে কী একটা কাজ করছে, নারান নীচে। বেসিনের কাছে দাঁড়িয়ে রিনি হাসির শব্দটা কান পেতে শুনল। মার ঘনশ্যাম হাসছে। তার ঘরে বসে বসে হাসছে। হেসে যেন গড়িয়ে পড়ছে। রিনির মাথায় এল না, নেহাত পাগল ছাড়া একলা ঘরে বসে কে আর হাসতে পারে! ছেলেটার মাথাও খারাপ নাকি?