কথাটা উপভোগ করে শরদিন্দু হাসতে লাগলেন।
নীহার সামান্য অপেক্ষা করে বিছানার পায়ের দিকে এগিয়ে গেলেন, মালপত্রের কাছে। তুমি কি সমস্ত সংসার উঠিয়ে এনেছ?
বাইরে বেরুলে কখন কী লাগবে বোঝা তো যায় না, নীহার। আমি দরকারিগুলোই নিয়েছি।
এত জিনিস তোমার দরকারি! মোটা মোটা বিছানাগুলো বয়ে এনেছ কেন? আমি না তোমায় বিছানাপত্র আনতে বারণ করেছিলাম।
শরদিন্দু কী যে বলবেন বুঝতে না পেরে বললেন, তুমি লিখেছিলে ঠিকই। তবে আমি ভাবলাম, বেডিং-ফেডিং নেওয়া ভাল, দরকারে কাজে লাগবে।
তোমার ওই রকম ভাবনা। আমার বাড়িতে আর দুজনের বাড়তি বিছানা নেই!
শরদিন্দু অপ্রস্তুত বোধ করলেন। তুমি যে কী বলো! ব্যবস্থা যা করে রেখেছ এ একেবারে রাজসূয়…।
তোমাদের বিছানা আমি খুলছি না। কাল রোদে দিয়ে আবার সব বেঁধেবঁধে রেখে দিতে বলব নারানদের। বেডিংয়ের মধ্যে তোমাদের দরকারি যদি কিছু রেখে থাকো কাল বের করে নিয়ো।
কী আছে আমার ঠিক মনে পড়ছে না। কাল দেখব।
ওই বড় ট্রাংকটা কার? তোমারই তো?
আমার। খোকারটা বোধহয় নীচেই থেকে গেছে।
আর-একটা ছোট ট্রাংক?
ওতে আমার জিনিস রয়েছে।
কী জিনিস? চাবি কোথায় তোমার?
চাবি জামার পকেটে।
সুটকেসে কী আছে?
খুচরো জিনিস। ওষুধপত্র আছে কিছু।
তোমার ওষুধ?
হ্যাঁ।
কী অসুখ তোমার?
ডেফিনিট কিছু নয়। ওই জেনারেল কমপ্লেন। বয়স বাড়লে যা হয়। এখানে ওখানে ব্যথা, অল্পসল্প দুর্বলতা, মাঝে মাঝে ঘুম না হওয়া–এই আর কি! ওষুধ-টষুধ তেমন একটা কিছু নেই, ক্রুশনসল্ট, হজমের দু-চারটে ওষুধ। তবে মাঝে মাঝে নিশ্বাসের একটা কষ্ট হয়, ব্রিদিং ট্রাবল..
নীহার দু পা এগিয়ে শরদিন্দুর ঝোলানো কোটের পকেটে হাত ডোবালেন। চাবি খুঁজতে খুঁজতে বললেন, নিশ্বাসের কষ্ট ভাল নয়। এখানে বড় কাউকে দেখিয়ে নাও। বুক নিয়ে অবহেলা করতে নেই।
শরদিন্দু চা খেতে লাগলেন।
পকেট হাতড়ে চাবিটা শেষ পর্যন্ত উদ্ধার হল। নীহার চাবি নিয়ে সোজা বাক্সর সামনে মাটিতে বসে পড়লেন।
তোমার কটা কাপড়-চোপড় আগে বের করে দিই। কোন ট্রাংক খুলব বলো?
শরদিন্দু বললেন, তুমি অত ব্যস্ত হচ্ছ কেন? আমি নিজেই বার করে নিতে পারতাম।
নীহার ট্রাংকের তালার সঙ্গে চাবি মেলাতে লাগলেন। কথার কোনও জবাব দিলেন না।
শরদিন্দু উঠে গিয়ে সিগারেট, লাইটার নিয়ে এসে আবার চেয়ারে বসলেন।
তোমায় দুটো পাজামা বের করে দিই, গেঞ্জিনীহার বললেন, কোন জামা পরবে? হাফ-হাতা ঢোলাগুলো?
দাও, যা হয় দাও; বাড়িতেই রয়েছি
নীহার বাক্স হাতড়ে কাপড়-চোপড় বের করতে লাগলেন।
সিগারেট ধরিয়ে নিলেন শরদিন্দু৷ আরও খানিকটা চা নিজেই কাপে ঢেলে নিতে নিতে বললেন, তোমাদের এই বাড়িটি বেশ। পাড়াটাও নিরিবিলি দেখছি।
নীহার হাতের কাজ সারতে সারতে জবাব দিলেন, নিরিবিলি আর কোথায়? এখন এখানে গায়ে গায়ে বাড়ি, একটুকরো জমি পড়ে নেই। কত লোক তরে এমনিতে পাড়াটা শান্ত-টান্ত। নীহার বাক্স হাতড়ে শরদিন্দুর পাজামা বের করে কোলের ওপর রাখলেন, একটা তোয়ালেও পাওয়া গেল। গেঞ্জি তাঁর চোখে পড়ছিল না।
শরদিন্দু নীহারকে দেখছিলেন। মাথার কাপড় নেমে কাঁধে পড়ে আছে। নীহারের চুল বেশ কোঁকড়ানো ছিল, এখন চুলের দীর্ঘতা কমে গিয়েছে, ঘনতা কমেছে, দু-এক জায়গায় ধূসর রং ধরেছে।
শরদিন্দুর মনে পড়ল নীহার একবার দুর্গামণ্ডপে পড়ে গিয়ে মাথার পেছনে কান ঘেঁষে বেশ জখম হয়েছিল। অনেকটা কেটে গিয়েছিল বেচারির। সেলাই পড়েছিল, জ্বর হয়েছিল বেশ। দাগটা নিশ্চয় এখনও আছে। শরদিন্দু প্রায় বলতে যাচ্ছিলেন কিছু, এমন সময় নীহার কথা বললেন।
নীহার বললেন, তুমি যদি আর দশ বারোটা বছর আগেও এখানে আসতে, ফাঁকা কাকে বলে বুঝতে পারতে! সন্ধের পর শেয়াল ডাকত। বিয়ের পর আমিই যখন এলাম, তখন সবে শ্বশুরমশাই একতলাটুকু করেছেন। আমাদের এই বাড়ি, আর ধরো আঙুলে গুনে তিনটে কি চারটে বাড়ি। রাজ্যের গাছপালা, বাদাড়, এঁদো পুকুর। অন্ধকার হল তো এই তল্লাট জুড়ে শুধু শিয়ালের ডাক, কানের পাশে ঝিঁঝি শুনছি সারাক্ষণ। ঘুটঘুট করত সব। ভয়ে আমি মরতাম বাপু। কী বিচ্ছিরি যে লাগত?
তোমার শ্বশুরমশাই না ইঞ্জিনিয়ার ছিলেন?
ডিজাইনার; সাহেব কোম্পানিতে কাজ করতেন। আমি যখন বিয়ের পর এলাম, তখন তাঁর বাতে অঙ্গ পড়ে গেছে। ডান হাতটা আর তুলতেও পারেন না উঁচু করে। ওঁর মুখে শুনেছি, এই জমি উনি হাজার দেড়েক করে কাঠা কিনেছিলেন। অনেক আগেই। আমাদের বাড়ি যখন হচ্ছে তখনই জমির দর চার-টার হয়ে গেছে। এখন তো জমিই নেই। বছর কয়েক আগেও পনেরো আঠারো হাজার টাকা কাঠা হয়ে গিয়েছিল।
শরদিন্দু মোটামুটি নীহারের শ্বশুরবাড়ির কথা জানেন। নীহারের শ্বশুর মোটামুটি সচ্ছলই ছিলেন। মানুষটিও খুব ভাল ছিলেন নিশ্চয়, নয়তো কে আর ডাক্তার ছেলের বিয়েতে একটা পাই-পয়সাও দাবি জানায় না। শরদিন্দুনীহারের শ্বশুরকে দেখেননি। তবে সবই শুনেছেন। নীহারের শ্বশুর স্বাস্থ্য বদলাবার জন্যে মাস দুয়েকের জন্যে বাইরে বেড়াতে যান। জায়গাটা অবশ্য মধুবনী শরদিন্দু আর নীহারের জায়গা। নীহারের কাকার সঙ্গে ভদ্রলোকের পরিচয় এবং বন্ধুত্ব হয়। সেই সূত্র ধরেই নীহারের বিয়ে। শরদিন্দুর তখন মনে হত, পৃথিবীতে এত জায়গা থাকতে, ভদ্রলোক তাদের শহরে কেন জলহাওয়া বদলাতে এসেছিলেন? তিনি না এলেও কি ভাগ্যের অদলবদল কিছু হত? বোধহয় হত না।