নীহার সবই জানেন। তাঁর কাছে শরদিন্দুর জীবনের অন্তত গোড়ার ছাব্বিশ সাতাশটা বছর নিজের জীবনের মতোই জানা। বিছানার পায়ের দিকের দেওয়াল ঘেঁষে মালপত্র ডাঁই করা আছে, সেদিকে তাকিয়ে থাকলেন নীহার। তারপর বললেন, মুখ টুখ ধুয়ে এসো; চা খাও।
চা হয়ে গিয়েছে?
হচ্ছে। পাঁচটা বাজতে চলল।
পাঁচ? …আমি বেশ খানিকটা ঘুমিয়ে নিয়েছি তা হলে! শরদিন্দু এবার ছোট মাপের হাই তুললেন। তুমি এত খাওয়ালে, খেয়েদেয়ে আমি সেই যে এসে ব্যাঙের মতন চিত হলাম, আর এপাশ ওপাশ করতে পারি না শরদিন্দু হাসতে গিয়ে কাশি বাধিয়ে ফেললেন।
নীহার মজা করে বললেন, তুমি আর খেলে কোথায়? মাছের কাঁটা বাছতে ভুলে গেছ, খাবে কী?
বিছানা থেকে নেমে পড়তে পড়তে শরদিন্দু বললেন, লোক আগে আমাদের ছাতু বলত, মনে আছে নীহার। এখন আবার বলে মাছু। কেন যে বলে কে জানে। তা মাড়ুদের দেশে থাকতে থাকতে মাছ খাওয়া ভুলে গিয়েছি। …তবে তুমি আজ যত রকম মাছ খাইয়েছ সব বলতে পারি।
নীহার হেসে বললেন, আচ্ছা,.সে আর বলবে কী? খাবার সময়েই তো আমরা বললাম।
শরদিন্দু ভুরু কুঁচকে বললেন, বললে নাকি! তবে তো আমার আর বলার উপায় থাকল না। পারশে মাছের ঝালটা আমার মুখে লেগে আছে এখনও। কত বছর পরে পারশে মাছ খেলাম। শরদিন্দু যেন ঝালের স্বাদটা এখনও জিবের কোথাও রেখে দিয়েছেন এমন এক মুখ করলেন।
নীহার বেশ শব্দ করেই হেসে উঠলেন। বুড়ো বয়সে কত যে করছ। যাও মুখ ধুয়ে এসো।
শরদিন্দু পরিতৃপ্ত মুখে ঘর ছেড়ে চলে গেলেন।
সামান্য পরে শরদিন্দু ফিরে এসে দেখলেন নীহার ঘরে নেই। চশমাটা খুঁজে নিয়ে বেতের হেলানো চেয়ারটায় তিনি বসলেন। বেতের ওপর পাতলা গদি পাতা রয়েছে: তুলোর গদি। গদিটা নতুন নতুন লাগছে। একরঙা একটা পিঠ কাপড়ও রেখেছেনীহার। শরদিন্দুর মনে হল, তাঁর জন্যেইনীহারের এত ব্যবস্থা। জানলার গা ঘেঁষেই বসলেন শরদিন্দু। পাখাটা আগের মতন ঘুরে যাচ্ছে।
বাইরে নীহারের গলা পাওয়া গেল। তেতলায় পা দিয়ে ঝি কিংবা চাকরকে কিছু বলছিলেন হয়তো, তারপর ঘরে এলেন।
তোমাকে আর নীচে নামালাম না, চা নিয়ে এলাম নীহার বললেন। তাঁর হাতে শরদিন্দুর চা।
শ্যাম কী করছে? শরদিন্দু জিজ্ঞেস করলেন।
চা খেয়ে এই তো উঠল,নীহার শরদিন্দুর চা ঢালতে ঢালতে বললেন, ঘরবাড়ি, রাস্তাঘাট দেখছে। বারান্দায় দাঁড়িয়ে। কলকাতা দেখছে।
শরদিন্দু চায়ের জন্যে অপেক্ষা করতে করতে বললেন, ওর কলকাতা দেখার খুব সাধ ছিল।
কার না থাকে, তোমারও ছিল. নীহার যেন মুচকি হাসলেন, চায়ের কাপ এগিয়ে দিয়ে শরদিন্দুর পাশেই দাঁড়িয়ে থাকলেন। কলকাতায় পড়তে আসার জন্যে তোমার কী বায়না! আমার বাপু বেশ মনে আছে। জ্যাঠামশাইয়ের মোটে ইচ্ছে ছিল না তুমি কলকাতায় পড়তে আস। তিনি চাইছিলেন পাটনা পাঠাতে। কাছে হত। কলকাতা ওঁদের পছন্দ ছিল না। তা তোমার একেবারে ধনুকভাঙা পণ, সেই কলকাতাতেই এলে। জেদে তোমায় কে হারায়।
শরদিন্দু যেন পুরনো কথাটাকে তেমন করে গায়ে মাখলেন না, বললেন, আমি শখ করে কলকাতায় আসিনি। কলকাতায় পড়ার আমার খুব ইচ্ছে ছিল। পুরো সাধটা আর মিটল কই। তার আগেই পালাতে হল। বলে চায়ের কাপে মুখ দিতে গিয়ে বললেন, তোমার চা?
আমি সন্ধের আগে চা খেতে পারি না আর। বলে সামান্য সরে এসে জানলার পরদাটা আরও গুটিয়ে দিলেন নীহার। রোদ আসছে না। বাতাসই আসছিল। মধ্যে অম্বল-টম্বল নিয়ে খুব ভুগেছিলাম। আলসারের মতন হয়ে গিয়েছিল। ধরাকাটা করে থাকতে হত। বিকেলে চা খেলে বুকটা জ্বালাজ্বালা করে। সন্ধেবেলাতেই খাই।
শরদিন্দু আয়েশ করে ধীরে সুস্থে চা খেতে লাগলেন। নীহার বললেন, আমি ভাবলাম, তুমি বসে বসে চা খাবে, আমি তোমার মোটঘাট খুলে যা-যা দরকার বের করে গুছিয়ে দেব।
শরদিন্দু বললেন, দেবেখন; একটু বোসো৷
বসব তো। আমি বসে বসেই কাজ করব। আমার কি আর দাঁড়িয়ে থাকার অবস্থা আছে। দেখছ না, কেমন ভারী হয়ে গিয়েছি।
ভারী–? শরদিন্দু হাসি হাসি মুখ করলেন।
মোটা বলবে তো? বলল। নীহার হাসলেন।
শরদিন্দুনীহারকে দেখতে লাগলেন। এই নীহারের সঙ্গে পুরনোনীহারের তুলনা করা ঠিক নয়, বয়স মানুষকে স্বাভাবিক ভাবেই বদলায়, কখনও কখনও অতিমাত্রায়, চেনাই যায় না। নীহারকে কিন্তু চেনা যায়। মুখের অদলবদল সত্ত্বেও আদলটি তেমন কিছু পালটায়নি। চৌকো ধরনের মুখে সামান্য চাপা থুতনি নীহারকে চিনিয়ে দিত, আজও দেয়। তফাতের মধ্যে, তখন যা ছিল ছিমছাম পরিষ্কার এখন তা ভরাট হয়ে গিয়েছে। সমস্ত মুখটাই প্রায় গোল দেখায়। নাকটি আরও ফুলে গিয়েছে, চোখ দুটি একেবারে সংসারী, মমতা মাখানো, মাসিপিসি ধরনের। নীহারের মাথার চুলও কোথাও কোথাও সাদাটে হয়ে আসছে। শরদিন্দুর মনে হল না, নীহারকে ঠিক মোটা বলা যায়, তবে বয়েসের মেদে কেমন এক গড়নভাঙা চেহারা হয়ে গিয়েছে নীহারের। নীহার এখনও সাদা থান পরে না, সরু কালো পাড়ের ধুতি পরে। হালকা হলুদ পাড়ের ধুতি পরে সে স্টেশনে গিয়েছিল। গায়ের জামা সাদা। গলায় সরু হার, হাতে সরু চুড়ি দু গাছা করে।
শরদিন্দু হেসে বললেন, তুমি আর মোটা কোথায়? ওই একটু..
নীহার হেসে জবাব দিলেন, মোটা নয়, তবে মোটামুটি–এই তো?