রিনি আরামের মুখে দই খেয়ে জিবের শব্দ করল বার কয়েক, তারপর বলল, এক মাসেরও বেশি! বাব্বা, ছেলেটার চোখে এত কী হয়েছে?
নীহার মেয়ের দিকে তাকালেন। ছেলেটা কীরে? তুই কি ওর নাড়ি কেটেছিস?
হেসে ফেলল রিনি। ভদ্রলোক বলব নাকি?
এর নাম নেই! অমন সুন্দর নাম-
ঘনশ্যাম।
নীহার প্রথমটায় বুঝতে না পারলেও পরে রিনির ঠাট্টাটা বুঝতে পেরে বললেন, রাখ; তোদের আজকালকার নামের যা ছিরি, নাম না খাঁড়ার ঘা, বোঝা যায় না। ও আমাদের তনুশ্যামই ভাল। আমিও তো শ্যাম বলি; তুই শ্যামদা বলবি।
রিনি হি হি করে হেসে উঠল। হাসির দমকে তার সারা গা কাঁপছিল। তুমি মা একেবারে যাচ্ছেতাই, রিনি বলল, ওকে আমার শ্যামদা বলতে বয়ে গেছে।
নীহারেরও খাওয়া শেষ হয়ে আসছিল। মেয়ের দিকে তাকিয়ে বললেন, বলবি না?
ধ্যুত!
শ্যাম তোর চেয়ে বয়সে বড়।
কত বড়? দু-এক বছর? আবার কী?
না–নীহার বেশ হেলিয়ে মাথা নাড়লেন, কম করেও বছর তিনেকের। আমার বেশ মনে আছে, আমি যখন ওকে দেখি তখন ওর বছর পাঁচ বয়েস। তুই তখন কতটুকু। মার কাছে গেলাম তোকে নিয়ে, বাবা বলল–হ্যাঁরে নীহার, এ যে মাথায় দেড় ফুটও হয়নি। আমার বাবা তোকে বলত, ফুটকি। …
রিনি চেয়ার ঠেলে উঠি উঠি ভাব করল। আঃ মা–তোমার বাপের বাড়ির গল্প আর আমি শুনতে পারি না।
নীহার মেয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকলেন কয়েক পলক, তারপর বললেন, আমার বাপের বাড়ির গল্প তোকে আমি কত শোনাই রে? খুব যে বলছিস?
রিনি হেসে বলল, রোজ শোনাও।
রোজ?
বেশ, রোজ না হয় না হল, একদিন অন্তর।
নীহার যেন অতিরিক্ত মনঃক্ষুণ্ণ হলেন। রিনি, তুই মার সঙ্গে চালাকি করছিস?
এবার রিনি উঠে দাঁড়াল। তার খুব হাসি পাচ্ছিল। মার বাপের বাড়ির গল্প সে এত শুনেছে যে, মার বদলে সে নিজেই দাদুদের বাড়ির, পাড়ার, মানুষজনের, কে কবে জন্মেছে, কবে মরেছে, কোন আমগাছে কোন বছরে বাজ পড়েছিল সব বলে দিতে পারে। রিনি জানে, মার কাছে বাপের বাড়ি বড় বেশি নিজের জিনিস। মাকে সে মাঝে মাঝে রাগাতে চাইলেও সত্যি কি আর দুঃখ দিতে চায়! রিনি হেসে বলল, বেশ বাবা, হপ্তায় একবার, না-হয় মাসে একবার তোমার বাপের বাড়ির গল্প শুনেছি, হল তো? যাক গে, তোমার শ্যামচাঁদের বয়েস আমার চেয়ে এমন কিছু বেশি নয়। এ বড়জোর তেইশ; আমি কুড়ি। আমি ওকে দাদা-টাদা বলতে পারব না। আজকাল মেয়েরা কথায় কথায় অত দাদা বলে না। আমি ওকে শ্যামচাঁদ বলে ডাকব। বলে রিনি হাসি চেপে বেসিনে মুখ ধুতে চলে গেল।
নীহার খানিকটা চুপ করে বসে থেকে ঘাড় ফিরিয়ে মেয়ের মুখ ধোওয়া দেখলেন। তারপর বললেন, তোর খুব ইয়ার্কি হয়েছে। শ্যামকে তুই শ্যামচাঁদ বলবি কেন? চাঁদটা তুই পেলি কোথায়?
রিনি বেসিনের কল বন্ধ করল। বলল, তোমার আঁচল থেকে মাটিতে পড়ে গিয়েছিল, কুড়িয়ে নিয়েছি, বলে খিল খিল করে হেসে উঠল।
.
০২.
শরদিন্দু তখনও আলস্য বোধ করছিলেন। বেলা পড়ে গিয়েছে, বিকেলেও হয়ে গিয়েছিল। ঘরের দরজাটা ভেজানেনা। মাথার দিকের জানলাটা বন্ধ, পাশের জানলা খানিকটা ভোলা, পরদা ঝুলছে গাঢ় রঙের। পরদার ওপর দিয়ে বিকেলের ঝিমোনো রোদ দেখা যাচ্ছিল।
অল্প করে দরজা খুলে নীহার ঘরে পা বাড়ালেন। তাঁর প্রথমে মনে হয়েছিল, শরদিন্দু ঘুমোচ্ছেন, পরে সিগারেটের গন্ধে বুঝলেন মানুষটি নিশ্চয় জেগে আছেন।
ঘুমোচ্ছ? নীহার বললেন। ঘুমন্ত মানুষকে কেউ ঘুমোচ্ছ বলে না, নীহার নিজেই যেন মনে মনে হাসলেন।
সাড়া দিলেন শরদিন্দু।
দরজার কাছেই দাঁড়িয়ে ছিলেন নীহার; সাড়া পাবার পর দরজার পাট খানিকটা খুলে দিলেন। চৌকাঠ থেকে রোদ অনেক দূরে সরে গেছে। ঘরের মধ্যে এগিয়ে এসে নীহার বললেন, ওপরের ঘরে শুতে কষ্ট হল? গরম পেলে খুব?
না। তোমাদের কলকাতায় আর গরম কোথায়! গরম আমাদের দিকে।
তোমাদের ওদিকে তো বলো পাহাড়।
পাহাড় মানে পাঁচমারি হিলসের একটা রেঞ্জ। আমাদের ওখান থেকে মাইল দশা শরদিন্দু বিছানা থেকে সামান্য উঠে বালিশে ভর দিলেন। এম পির ক্লাইমেট সব জায়গায় এক রকম নয়। কোথাও কোথাও বেজায় গরম পড়ে, আমাদের বিহারের মতন। কোনও কোনও জায়গায় মডারেট ক্লাইমেট। তবে শীতটা বেশিই হয়।
নীহারের মনে হল ঘুম থেকে শরদিন্দু বেশিক্ষণ ওঠেননি৷ হাই তুলছেন বড় বড়। জল খাবে? নীহার জিজ্ঞেস করলেন।
দাও। তোমাদের ঠাণ্ডা-জল নয়।
ঘরেই জলের পাত্র ছিল। নীহার জল গড়িয়ে দিলেন।
শরদিন্দু তৃষ্ণার্ত হয়েছিলেন; জল খেয়ে আরামের শব্দ করলেন। তারপর কী মনে করে বললেন, আমার পেটে কলকাতার জল পড়ল কত বছর পরে বলো তো?
নীহার মুচকি হাসলেন। সে তো তোমারই মনে রাখার কথা।
শরদিন্দু যেন হিসেব করছিলেন নীহারের মুখের দিকে তাকিয়ে। বললেন, বছর আটাশ হবে। হবে না?
নীহার সায় দেওয়া ঘাড় নাড়লেন, ওই রকমই হবে।
আমি কলকাতা ছাড়লাম, যুদ্ধের মাঝামাঝি। ফরটি টুয়ে, অগাস্ট রেভুলেশনের বছর।
ছিলেই বা কবছর। নীহার এবার মাথার দিকের জানলা খুলে দিচ্ছিলেন। পাশের জানলাও পুরোপুরি মেলে দিলেন। ঘরে পড়ন্ত বিকেলের স্বাভাবিক আলো এল।
শরদিন্দু বললেন, কলকাতায় আমার বছর চারেক থাকা। কলেজের কটা বছর। যুদ্ধ লেগে সব এলোমেলো হয়ে গেল; আমি হিন্দু ইউনিভার্সিটিতে চলে গেলাম।