গাড়ি পি জি হাসপাতালের কাছাকাছি আসতে তনুশ্যাম আস্তে করে নীহারকে বলল, আমি চশমাটা খুলব একটু?
নীহার মাথা নেড়ে তাড়াতাড়ি বললেন, না না, না বাবা। এই দুপুর, রোদ গনগন করছে, গরম বাতাস, দেখছ না।
শরদিন্দু ঘাড় ফিরিয়ে বললেন, চোখে জল পড়তে শুরু করবে, শ্যাম; ট্রেনেই যথেষ্ট অত্যাচার হয়ে গেছে।
তনুশ্যাম আর কোনও কথা বলল না।
রিনি মুখ ফিরিয়ে তনুশ্যামকে দেখছিল। মার কাছে সবই শুনেছে রিনি। তনু চোখের অসুখে ভুগছে অনেকদিন ধরে। বাচ্চা বয়স থেকেই। কয়েক বছর বাড়াবাড়ি যাচ্ছে। অনেক ডাক্তার দেখিয়েছে, চিকিৎসা করেছে; কিছু হয়নি। শরদিন্দুমামা ছেলেকে নিয়ে কলকাতায় এসেছেন চোখের চিকিৎসার জন্যে। রিনির বাবা নিজেই চোখের ডাক্তার ছিলেন কিন্তু তিনি তো আর নেই, রিনির বছর তেরো বয়সে তিনি চলে গেছেন। বাবা থাকলে বাবাই তনুর চোখ দেখতে পারত। বাবা না থাকলেও কলকাতায় অনেক বড় বড় ডাক্তার রয়েছেন, তাঁরা দেখবেন, বাবার বন্ধু হিসেবেও দু-একজনকে মা চেনেন, তাঁরা দেখবেন।
তনুশ্যামের জন্যে রিনির দুঃখই হল। মার কাছে যখন শরদিন্দুমামার চিঠি আসত, মা যখন এই ছেলেটির চোখের অসুখের কথা বলত-টলত, রিনি হয়তো সহানুভূতি বোধ করত কিন্তু তার তেমন কোনও কৌতূহল ছিল না। তারপর সে শুনল শরদিন্দুমামারা কলকাতায় আসছেন। ইদানীং তার খানিকটা কৌতূহল হচ্ছিল। আজ তনুশ্যামকে দেখে রিনি বুঝতে পারছে বেচারির সত্যিই বড় কষ্ট। চোখ দুটো থেকেও যেন না থাকার মতন হয়ে আছে। রিনি তনুর চোখ দুটি কেমন তা দেখার জন্যে কেমন উদগ্রীব হয়ে উঠল।
হরিশ মুখার্জি রোডে গাড়িটা ঘুরে যাবার পর রিনি বাইরের দিকে তাকিয়ে থাকল। ফুটপাথ ঘেঁষে ছায়া পড়েছে খানিকটা, গাছের ছায়া। অন্যদিকে রোদ ঝলসে যাচ্ছে। একটা কৃষ্ণচূড়া গাছের তলায় কিছু খই পড়ে আছে ছিটিয়ে, কয়েকটা শুকনো ফুল। বোধহয় খানিকটা আগে হাসপাতাল থেকে কারও মৃতদেহ চলে গেছে, তারই কিছু চিহ্ন। রিনি বাইরের দিকেই তাকিয়ে থাকল।
বাড়ি এসে মালপত্র তুলতে তুলতে দুটো বেজে গেল। নীহার খুব ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। জিনিসপত্র টানাহেঁচড়া খোলাখুলি করতে দিলেন না। মাঝদুপুর পেরোতে চলল, এখন রোদে-তাতে পোড়া মানুষগুলো আগে একটু জিরিয়ে স্নান-খাওয়া করে নিক, শরীরটা জুড়োক, তারপর বাক্স-বিছানা খুললে হবে।
ব্যবস্থার কোনও ত্রুটি নীহার রাখেনি। বাড়িটা এমন কিছু ছোট নয়। বাঁ দিকটায় দুঘর ভাড়াটে; তাদের সঙ্গে এদিকটার কোথাও কোনও সম্পর্ক নেই। ওপাশটা আলাদা। এপাশে ডান দিকে নীচের তলায় একটা নার্সারি স্কুল, দোতলায় নীহাররা থাকেন, তিনতলাতেও দেড়খানা ঘর রয়েছে। নীহারদের দিকটা পড়েছে দক্ষিণে। বারান্দা ঘেঁষে পর পর ঘর, পুবের দিকে একটা বাঁক মতন আছে। শরদিন্দুর জন্যে তেতলার ঘরটাই রেখেছে নীহার। গরমের দিনে দুপুরটায় খানিক কষ্ট হলেও বিকেল পড়ে গেলে বেশ ভালই লাগবে। ঘরের লাগোয়া ছোট এক ফালি ছাদ, টবের কিছু গাছপালা, ফাঁকা, নিরিবিলি কাজ চালাবার মতন বাথরুমও আছে একটা। বাকি আধখানা ঘরে এ বাড়িটার নানান অব্যবহার্য জিনিস জমা করা ছিল। সেটা কিছু পরিষ্কার করা হয়েছে, দরকারে জিনিসপত্র রাখা যেতে পারে।
দোতলায় একটা ঘর ঠিক করা হয়েছে তনুশ্যামের জন্যে। কোনার দিকের ঘর। ঘরটা ছিল রিনির পড়াশোনার, একপাশে তার গানবাজনার কিছু সরঞ্জাম থাকত, আর যত টুকিটাকি। সেই ঘরটা পরিষ্কার করিয়ে জিনিসপত্র সরিয়ে খাট পেতে তনুর ঘর করে দেওয়া হয়েছে; পাশেই নীহারের ঘর। নীহারের ঘরের গায়ে গায়ে রিনির শোবার ঘর।
চওড়া বারান্দার সামনে উঁচু রেলিং; রেলিংয়ের মাথায় মাথায় রোদ-জল বাঁচাবার জন্যে কাঠের ফ্রেমে কাচের মোটা শার্সি বসানো, আগাগোড়া। সাদা এবং নীলচে রঙের শার্সিগুলো বাহারি। বারান্দার একদিকে বসার অন্যদিকে খাওয়া-দাওয়ার ব্যবস্থা। নীহারের হাতের গুণে সবই পরিষ্কার, পরিচ্ছন্ন, পরিপাটি।
স্নান খাওয়া-দাওয়া শেষ করতে করতে তিনটে বেজে গেল। তারপর নীহার বসলেন খেতে, রিনিও মার সঙ্গে বসল। শরদিন্দুকে তাঁর ঘরে পাঠানো হয়েছে বিশ্রামের জন্যে। তনুশ্যাম তার ঘরে শুয়ে আছে বোধহয়।
রিনি বলল, মা, আজ আর আমার মাধুরীদের বাড়ি যাওয়া হবে না। এরপর আর কখন বেরুব?
নীহার বললেন, আজ আর কী করে বেরুবি; বাড়িতে মানুষজন এল। বিকেলে ওদের গোছগাছ করে দিতে হবে না?
গোছগাছের আছে কী? তুমি তো সবই গুছিয়ে রেখেছিলে। ওরা যে কেন গন্ধমাদন বয়ে আনল বাপু কে জানে!
নীহার মেয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে হাসিমুখে বললেন, ওই রকম মানুষ যে!
বলে একটু থেমে আবার বললেন, কতদিন থাকবে তার তো কিছু ঠিক নেই, পনেরো দিন একমাস হতে পারে আবার বেশিও হতে পারে। তাই লটবহর বয়ে এনেছে।
রিনি এবার একটু দই মুখে দিল। স্বাদ পরখ করে সামান্য নুন মেশাল। বারান্দার শার্সিগুলো প্রায় সব বন্ধ। কাচের নীলচে রঙের জন্যে ছায়া পুরু হয়ে আছে: খোলা দু-এক পাট শার্সি দিয়ে আলো আর বাতাস আসছিল। মাথার ওপর হু হু করে পাখা ঘুরছে। বারান্দার বেসিনের দিকে পেতলের টবে একটা অর্কিড, তার প্রায় মাথার ওপর রিনির হাতের মানিপ্ল্যান্টের লতানো নকশা।