নীহার এবার ঘাড় ফিরিয়ে মেয়ের দিকে তাকালেন। হাসছিস?
রিনির জবাব দেবার কিছু ছিল না; সে খুব বুদ্ধি করে আঙুল দিয়ে দরজার বাইরেটা দেখাল। হাসির উপাদানটা কোথায় তা জানার উপায় থাকল না। গাড়ি চলছে। রিনি তার জানলার দিকেই আঙুল দিয়ে বাইরে কিছু দেখিয়েছে। কাজেই উপাদান যদি কিছু থেকেই থাকে সেটা পেছনে পড়ে গেছে এবং আড়ালে। নীহার কিছুই বুঝতে পারলেন না। তিনি বরং দেখলেন, গাড়িটা হাওড়া ব্রিজ দিয়ে যাচ্ছে। তনুশ্যামকে হাওড়া ব্রিজ আর গঙ্গা দেখাতে লাগলেন নীহার। তনুশ্যামও অবাক হয়ে হাওড়া ব্রিজ দেখতে লাগল।
শরদিন্দু সামনে থেকে বললেন, আমাদের সময়ে ছিল কাঠের পুল–ফ্লোটিং ব্রিজ। নতুনটা সবে তৈরি হচ্ছিল। বলে শরদিন্দুও যেন সেই পুরনো ব্রিজটার ছিটেফোঁটা অস্তিত্ব খুঁজতে লাগলেন। ধরতে পারলেন না।
নীহার বললেন, তোমাদের সময়ের কলকাতার কতটুকুই আর আছে। সে কলকাতার সঙ্গে এখানকার আর মিল খুঁজে পাবে না।
তাই শুনি, শরদিন্দু বললেন আস্তে করে, পুরনো কলকাতা মরে গেছে।
রিনির পায়ের কাছে একটা বাস্কেট, তার ওপর একটা হাত দেড়েকের সুটকেস, কোনও রকমে রিনি পায়ের আঙুলগুলো রেখে গোড়ালি তুলে বসে আছে। তার কোমরের তলার দিকের বিশ্রী চাপ পড়ছিল তনুশ্যামের ওপর। ভীষণ অস্বস্তি হচ্ছিল রিনির। একদিকে ভার দিয়ে বসেও সে নিজেকে সামলাতে পারছিল না। তনুশ্যামও নড়তে পারছে না; তার ওপাশে মা, জলের ফ্রেমসমেত কুঁজোটা তনুর পায়ের তলায়, কোলের ওপর টাইমটেবল, কাগজপত্র, বই। রিনির পা যদি ভার রাখতে পারত তাকে এভাবে হেলে পড়তে হত না ছেলেটার দিকে। তবু রিনি চেষ্টা করল যাতে তার পায়ের দিকের চাপটা আলগা করা যয়। মার তনুশ্যামের তনুটি রোগা-সোগা, বড় জোর বলা যায় ছিপছিপে। গায়ের চেককাটা পুরো হাতার মোটা শার্টটার জন্যে রোগাটে ভাব অতটা বোঝা যাচ্ছে না। ছেলেটার রং শ্যামলা, প্রায় কালচে। বোধহয় সেইজন্যেই নাম হয়েছে তনুশ্যাম। মুখটি খুব মোলায়েম, মেয়েমেয়ে ঢঙের, মানে–মেয়েলি নয়, কিন্তু নরম, শান্ত ধরনের। সারা মুখে পাতলা দাড়ি, মাথার চুলগুলো রুক্ষ, লালচে, পাতলা। চোখে মোটা কাচের চশমা, সাদা কাচের চশমা নয়, রঙিন চশমা–তাতে আবার কানের দিকটাও আড়াল করা। চশমাটা এমনই যে চোখ পুরোপুরি ঢাকা তনুশ্যামের, চোখ দেখা যায় না। রিনি যতবার চোখ দেখার চেষ্টা করেছে, ঘন নীলচে কাঁচ ছাড়া আর কিছুই দেখতে পায়নি। অথচ তনু তার গগলস ধরনের চশমার ভেতর থেকে নিশ্চয় রিনিকে দেখতে পাচ্ছে। রিনির এতে কেমন এক আপত্তি হচ্ছিল, তুমি আমায় দিব্যি দেখবে আর আমি তোমায় দেখব না তা হয় না।
গাড়িটা হাওড়া ব্রিজ ছাড়িয়ে এসেছে কখন। ডান দিকে আসতে আসতে আবার যখন বাঁয়ে মোড় নিল, রিনি একেবারে আচমকা বালিশের মতন ধপ করে তনুশ্যামের কোলে ঢলে পড়ল। তার মাথাটা তনুর বুকের ওপর দিয়ে গড়িয়ে একেবারে কোলে কাগজপত্রের ওপর।
রিনি ভীষণ অপ্রস্তুত। তাড়াতাড়ি উঠতে গিয়ে শুনল তনুই হাসছে।
নীহার মেয়ের গড়িয়ে পড়া দেখে অবাক। তারপর হেসে ফেললেন, ঘুমে ঢুলছিলি নাকি?
রাগ করে রিনি বলল, ধত, এভাবে বসা যায়?
নীহার বললেন, কেন যাবে না। আমরা বসে নেই? তুই যদি বসে বসে ঢুলিস, তবে আর বসার দোষ কী!
রিনি বলল, আমি মোটেও ঢুলিনি। মার চেয়েও তার বেশি রাগ হল, তনুর ওপর। ছেলেটা কেমন করে হাসল! অসভ্য একেবারে। রিনি যেন জেদ করেই তনুকে পাশ থেকে চেপে কোমর দিয়ে ঠেলে ঠেলে নিজের বসার জায়গা করতে লাগল। তনু আরও গুটিয়ে নিতে লাগল নিজেকে। শরদিন্দু হঠাৎ বললেন, নীহার, হাইকোর্ট।
নীহার হেসে বললেন, তুমি দেখো তোমরা তো কোনও কালে বাঙাল ছিলে শুনেছি।
তনু এদিক ওদিক তাকিয়ে হাইকোর্ট খুঁজছিল, রিনি চট করে আঙুল দিয়ে ইডেন গার্ডেনসের দিকটা দেখিয়ে দিল। বাঙালকে হাইকোর্ট দেখানো আর কী! তারপর মুখ ফিরিয়ে হাসতে লাগল।
গড়ের মাঠের কাছে এসে নীহার তনুকে ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল দেখাচ্ছিলেন, রিনি দাঁতে ঠোঁট কেটে টুক করে বলল, পাশেই সবটা গড়ের মাঠ। বলে, মুখ ফিরিয়ে হাসল।
শরদিন্দু বললেন, নীহার, আমি কখনও ওই মেমোরিয়ালের ভেতরে যাইনি।
নীহার হেসে বললেন, কলকাতায় থাকতে তুমি বাপু দুটি মাত্র জিনিস দেখেছিলে, এক তোমার কলেজ আর ঠনঠনিয়ার কালীবাড়ি।
শরদিন্দু হাসির গলায় বললেন, আরে না না, আরও কত কী দেখেছি। আমি বছরে বার-দুই করে জু-য়ে বেড়াতে যেতাম।
নীহার বেশ জোরেই হেসে ফেললেন। হেসে কী মনে হল, তাড়াতাড়ি ছেলেমেয়ের দিকে তাকালেন। তারপর নিজেকে সামলে নিয়ে বললেন, তুমি তো শিবপুরেই বেশি যেতে।
হ্যাঁ, বটানিকসে।
তা তো যাবেই; ওই গাছ-গাছড়াই তোমার জিনিস…এলে যখন আর একবার দেখে যেয়ো৷
যাব, একবার।
মামা, রিনি বলল, আমি আপনাকে এবার একদিন ভিক্টোরিয়ায় ঘুরিয়ে নিয়ে যাব।
শরদিন্দু বললেন, বেশ তো, একদিন সবাই মিলে বেড়াতে আসা যাবে।
শুধু ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল কেন–নীহার বললেন, তোর মামাকে নিয়ে সারা কলকাতা চষে বেড়াস। কবে কলেজে পড়ার সময় কলকাতায় ছিল, সে কলকাতা আর নেই। কত দেখার জিনিস হয়েছে! বলে তনুর দিকে তাকালেন, ছেলেটাও কলকাতায় এল প্রথম, ওকে সব দেখাতে হবে।