অবনী এবার হাসল। জোরে নয়, মৃদু শব্দ করে, যেন নিজেকে শোনাল। অদ্ভুত এক চিন্তা এল মাথায়: কখনও কখনও নাকি দূরে কোনও আত্মীয়-টাত্মীয় মরে গেলে হঠাৎ তার ডাক শোনা যায়। প্রিমোনিশান? টেলিপ্যাথি? ললিতা কি মারা গেল নাকি হঠাৎ? …ননসেন্স! হুইস্কিটা ভালই। মনিঅর্ডারে ললিতা এখনও তার আত্মীয়।
ঘরে ঢোকার সময় অবনী যেন সহসা তার পাশে বিজলীবাবুকে অনুভব করতে পারছে সামান্য মুখ ফেরাল। বিজলীবাবু তার মুখের পাশে মুখ লাগিয়ে যেন চলেছেন। সারা মুখে একটা হাসি।
হাসিটা ভাল লাগল না অবনীর। বিজলীবাবুর মুখ হাসিতে ফুলে উঠছে ক্রমশ, বেলুনের মন বাড়ছে, শেষ পর্যন্ত ফেটে যাবে।
বিরক্ত হয়ে অবনী মুখ ফিরিয়ে নিল।
কানের পাশে বিজলীবাবু যেন ফিসফিস করে বললেন, ও কে?
কে আবার, ললিতা। অবনী কোনওদিকে তাকাল না।
বিজলীবাবুর মুখ যেন ফেটে যাবার অবস্থা: ফেমিনাইন জেন্ডারের মজা কী জানেন, ওটা কী বোঝ যায় না, কখন কাকে দেখছেন কী ভাবছেন…
অবনী ঘরে চলে এল। বিজলীবাবুর হাসি পিচকিরির রঙের মতন যেন তার চেতনার কোথাও ছিটিয়ে পড়েছে।
বিছানায় এসে বসল অবনী। বসল এবং বিজলীবাবুকেই যেন মনে মনে বলল:
ললিতাকে আপনি দেখেননি বিজলীবাবু, শরীরে আঙুল ছোঁয়ালে এক সময় আমার সমস্ত কিছু জ্বলে যেত। পাকা বড় আঙুরের মতন শরীর, নোখের দাগ লাগলে যেন ফেটে রস গড়িয়ে পড়বে। ললিতার জন্যে আমি পাগল হয়েছিলাম। ওকে বিয়ে করার পর, আগেও তিন-চারটে বছর, ললিতাকে আমি রাক্ষসের মতন ভোগ করেছি। …তখন, আমার ধারণা, আমি তাকে ভালবাসতাম। …অথচ, পরে আমার ওর প্রতি আকাঙ্ক্ষা চলে গেল, আস্তে আস্তে; ভালবাসাও থাকল না। তৃষ্ণার্তের পিপাসা মিটে গেলে যেমন হয়। তখন আর ললিতাকে ভাল লাগত না, অকারণ, অপ্রয়োজনীয় মনে হত। আমাকেও ললিতার প্রয়োজন ছিল না। ভোগস্পৃহা মরে গেলে ভোগ্যবস্তু ভোগ করা যায় না, উপভোগও নয়। আমার ভোগস্পৃহা মরে গিয়েছিল।
১. চারজনের আর জায়গা
০১.
পাশাপাশি চারজনের আর জায়গা হল না। মালপত্রেই গাড়ির বারো আনা ভরে গিয়েছিল; শরদিন্দু যেরকম লটবহর জুটিয়েছেন, মনে হচ্ছিল, আধখানা সংসারই তুলে এনেছেন। হাওড়া স্টেশনের ট্যাক্সিঅলাদের যা ধরন, তাতে এই পর্বতপ্রমাণ মালপত্র তারা কিছুতেই এক গাড়িতে নিত না। কাঠফাটা দুপুররোদে দাঁড়িয়ে ট্যাক্সি-ট্যাক্সি করতে হত। ছেলেটার কষ্ট হত খুব, চোখের যন্ত্রণায় হয়তো ছটফট করত। শরদিন্দুও রোদে-তাতে অস্থির হয়ে উঠতেন। সাতপাঁচ ভেবে নীহার বাড়ি থেকে বেরুবার সময় একটা প্রাইভেট গাড়ি ভাড়া করে নিয়ে এসেছিলেন; দেবু দত্তদের গাড়ি, কখনও-সখনও তাঁকে এরকম দু-চার ঘণ্টার জন্যে ভাড়া নিতে হয়। ড্রাইভার কেষ্ট ছেলেটিও ভাল, দরকারে সাহায্য করে সবরকম। সোয়া এগারোটার গাড়ি এল পৌনে একটায়। এতক্ষণ হাঁ করে দাঁড়িয়ে থাকা, গরমে পচে যাওয়া; তবু কেষ্ট একটুও বিরক্ত নয়। নীহার কুলিদের বাবা বাছা করে, কেষ্টর খবরদারিতে মালপত্র সব তুলিয়ে নিয়ে শরদিন্দুকে সামনে বসতে বললেন। সামনেও কিছু মালপত্র রাখতে হয়েছে। নীহাররা বসলেন পেছনে; নীহার, তনুশ্যাম আর রিনি।
গাড়ি ছাড়লে নীহার মাথার কাপড় নামিয়ে ঘাড়-গলার ঘাম মুছতে লাগলেন; চেহারা দিন দিন ভারী হয়ে উঠেছে, তার ওপর এই দুপুরের রোদ, গরম, প্ল্যাটফর্মে বসে অপেক্ষা, ভিড়।
নীহারের পাশে তনুশ্যাম। ছেলেটাকে জানলার পাশে বসাতে সাহস হয়নি নীহারের। গরমের হলকা যদি চোখে লাগে বেচারার খুব কষ্ট হবে। তনুর পাশে ডান দিকের দরজা ঘেঁষে বসে আছে রিনি, নীহারের মেয়ে। রিনি নিজেই হাওড়া স্টেশনে আসতে চেয়েছিল। নীহারও চেয়েছিলেন রিনি আসুক। তিনি একলা আসার চেয়ে মা-মেয়ে মিলে শরদিন্দুদের নিতে আসছেন, এটাই ভাল দেখায়।
রিনি যে শরদিন্দুদের দেখার পর থেকে আগাগোড়া হেসে মরে যাচ্ছে–এটা তেমন বোঝার উপায় নেই। হাসিটাকে সে নানাভাবে কখনও মুখ ফিরিয়ে, কখনও একেবারে উলটো দিকে ঘুরে দাঁড়িয়ে, কখনও বা ঠোঁট কামড়ে, মুখ আড়াল করে লুকিয়ে রাখছে। যখন আর সামলাতে পারছে না, হেসেই ফেলছে। নীহারের অবশ্য মেয়ের অত হাসি দেখার সময় কই! কুলি আর মালপত্রের দিকেই নজর তাঁর। শরদিন্দুও যেন নীহারের ব্যবস্থাপনা দেখছেন। আর তনুশ্যাম অবাক হয়ে দেখছে হাওড়া স্টেশন, লোকজন, ট্যাক্সিস্ট্যান্ড, আশপাশ।
শরদিন্দুর সাজপোশাকটাই রিনির কাছে খুব হাস্যকর লাগছিল। চার-পাঁচ, কি বড়জোর ছশো মাইল দূর থেকে আসছেন শরদিন্দুমামা; কিন্তু পোশাক দেখলে মনে হবে, খাস বিলেত থেকে এইমাত্র উড়ে এসে নেমেছেন। তাও আবার এখনকার বিলেত নয়, কেননা সেটা রিনি ছবি-টবিতে সিনেমায় দেখেছে। মামার পোশাকটা যেন ডেভিড কপারফিল্ডের লোকজনের মতন। রিনি ইংরেজি সিনেমায় সেকেলে বিলেতি পোশাক-আশাক চক্ষে দেখেছে বলে তার এই রকম মনে হচ্ছিল। এই পচা গরমেও বিচিত্র সুট, টাই, ভেস্ট এবং টুপি। মার ধমকে টুপিটা অবশ্য এখন মামার কোলে; কিছু কাঁচা, কিছু পাতলা সাদা চুল টুপির চাপে পাট হয়ে বসে আছে মাথায়।
মামার ছেলেটি যদিও পোশাকে-আশাকে মামার মতন নয়, তবু তার প্যান্টের কাটছাঁট, চেককাটা জামাটার বাহার দেখলে মনে হবে, এ একেবারেই খোট্টাই ছাঁট। নামেরই কী বাহার ছেলেটার। তনুশ্যাম! ঘনশ্যাম হতে দোষ ছিল কোথায়? রিনিদের কলেজে এক ঘনশ্যাম ছিল, ঘণ্টা বাজাত। রিনিরা তাকে বলত, ঘণ্টাশ্যাম। একে তো আর তা বলা যায় না। শরদিন্দুমামার ছেলে, মার খুব আদরের জন। অথচ মা ছেলেটাকে নাকি দেখেইনি; একবার মাত্র দেখেছিল, তখন তনুশ্যাম একেবারে বাচ্চা, হাফপ্যান্টও হয়তো ঠিক মতন পরতে পারত না। তা হলে রিনি তখন কত? মানে বয়েস কত রিনির? মা বলে, রিনি তখন কাঁথা ভেজাত। দমকা হাসি এসে গেল রিনির, সে হেসে ফেলে গলা চাপবার চেষ্টা করল, রুমালটা কোলের আশেপাশে কোথায় পড়ে গেছে, আঁচলটাই মুখে চেপে ধরল।