আপনার কোনও আফশোস নেই?
এমনিতে নেই, বিজলীবাবু হাত তুলে নাড়লেন। একটা প্রাইভেট আফশোস অবশ্য আছে: আমার ডান বাঁ দু দিকেই শূন্য কুম্ভ। বুড়ো আঙুল দিয়ে বিজলীবাবু তাঁর ডান বাঁ দেখালেন।
অবনী ঠিক বুঝতে পারল না, তাকিয়ে থাকল। জিবের স্বাদের জন্যে কয়েকটা ভাজা আলু মুখে দিল।
বিজলীবাবু হাত বাড়িয়ে দেশলাই তুলে নিলেন, চোখের পাতা আধবোজা করে হাসলেন, বউয়ের কথা বলছি। আমার দুটো বউই বাঁজা। পুত্রার্থে ক্রিয়তে ভার্যা। …আমার ভার্যাতে কিছছু হল না।
অবনী বিজলীবাবুকে দেখছিল: বোঝা যায় না তেমন তবু সন্দেহ হয় বিজলীবাবুর মনে গভীর একটি ক্ষোভ আছে। সহসা অবনীর চোখের সামনে কুমকুমের মুখ ভেসে উঠল, একমাথা চুল, রিবন বাঁধা, সামনের দাঁতটা পড়ে গেছে। মেয়েটা এখন আরও বড় হয়েছে, দাঁত উঠে গেছে এতদিনে।
বিজলীবাবু শুধোলেন, ভগবান-টগবানে বিশ্বাস আছে, মিত্তিরসাহেব?
অবনী যেন কুমকুমকে টুপ করে ডুবে যেতে দেখল। বিজলীবাবু সিগারেট ধরালেন আবার।
দু-একটা জায়গায়– বিজলীবাবু বললেন, যা মারার–ওই ভগবান শালাই মারে।
অবনী একটু হাসার মুখ করল, করে তার গ্লাসের বাকি পানীয়টুকু শেষ করল।
সামান্য সময় চুপচাপ। বাইরের জানলা দিয়ে বাতাস আসছে, মাথার ওপর পাখা চলছে, তবু গরম লাগছিল। বিজলীবাবু মুখ মুছলেন। চশমাটা পরলেন আবার। অবনীর চোখের তলা যেন ঈষৎ স্ফুরিত হয়েছে, সাদা জমিটা সামান্য লালচে। স্বেদ জমেছে মুখে।
অবনী উঠে গিয়ে পাখাটা বাড়িয়ে দিল। দিয়ে ভেতরে চলে গেল। সামান্য পরে ফিরল আবার। বিজলীবাবু চোখ বন্ধ করে কোনও পুরনো বাংলা গানের সুর আলাপ করার চেষ্টা করছিলেন গুনগুন করে। ফিরে এসে অবনী আবার দুজনের গ্লাস তৈরি করল।
বিজলীবাবু বললেন, কথায় কথায় আসলটাই ভুলে যাচ্ছি, মিত্তিরসাহেব। …ওই যে মেয়েটি চোখের ডাক্তার–ওঁর ব্যাপারটা কী?
কীসের ব্যাপার?
এখানে এসে জুটল যে। সুরেশ-মহারাজের আত্মীয় নাকি?
জিজ্ঞেস করিনি।
কী নাম?
হৈমন্তী।
উপাধিটা কী?
জানি না। …জিজ্ঞেস করিনি!
কোথ থেকে আসা?
কলকাতা।
বিজলীবাবু কয়েক মুহূর্ত চুপচাপ থেকে শেষে বললেন, একটু বয়েস হয়ে গেছে, তা হোক, চেহারাটা আছে। …বিয়েটিয়ে করেছে বলে তো মনে হল না।
অবনী মাথা নাড়ল, জানি না। বোধহয় না। …বিয়ে করলেও আজকাল অনেকে মাথায় সিঁদুর দেয় না। ব্রাহ্ম হতে পারে, ক্রিশ্চান হতে পারে। এরাও অনেকে সিঁদুর পরে না। অবনী পরিহাস করে বলল।
সুরেশ-মহারাজ পাকা হিন্দু। বিজলীবাবু যেন মনে মনে হিসেব করলেন, না, মহারাজজির স্ত্রী হলে সিঁদুরটা থাকত।
অবনী সিগারেট ধরাল। গা এলিয়ে বসে উলটো দিকের জানলার দিকে তাকিয়ে থাকল, বাইরে পেয়ারা ডাল নড়ছে অন্ধকারে, বারান্দার আলোর মৃদু আভায় ডালের কয়েকটি পাতা শাড়ির আঁচলের মতন মনে হচ্ছে।
বিজলীবাবু বললেন, শুনেছি আজকাল আশ্রমটাশ্রম করতে হলে একজন করে মা লাগে। সুরেশ-মহারাজ কি মা আমদানি করলেন…?
অবনী কোনও জবাব দিল না।
উত্তরের অপেক্ষা করে শেষে বিজলীবাবু আবার বললেন, না–মিত্তিরসাহেব, আমাদের মহারাজজি আবার ও-সব সাধনাফাধনাও করে না। মা আমদানিই বা করবেন কেন!
অবনী এবার কথা বলল, সেবা-টেবা করতে এসেছে হয়তো। আপনার সুরেশ-মহারাজের ভক্ত।
ভক্তরাই সব লণ্ডভণ্ড করে দেয়। এ তো তারও বেশি–ভক্তি…। আপনার মতন মানুষ আর কটা পাবেন, ফেমিনাইন জেন্ডার বাদ দিয়ে চলে।
অবনী হেসে ফেলল। আপনার সুরেশ-মহারাজ কি মেয়েতে ভুলবে?
ভোলা উচিত নয়। …তবে দেবী কেমন তার ওপরেই দেবতার সেলফ কনট্রোল। এ তো আমার কথা নয়, শাস্ত্ৰতেই দেখুন–অমন বোমতোলা খেপা শিব–সেও উমাকে দেখে মজে গেল। দেবীতেই সৃষ্টি-দেবীতেই প্রলয়। কিছু বলা যায় না, এই দেবীটি সুরেশ-মহারাজের চোখ ফুটিয়ে দিতে পারে আবার বন্ধ করে দিতেও পারে।
অবনী চেয়ারের কাঁধে মাথা হেলিয়ে চোখের পাতা বন্ধ করল। মাথা ভারী হয়ে আসছে। বিজলীবাবুর কথায় হাসবার চেষ্টা করল, তেমন হাসতে পারল না।
রাত হয়েছে। বিজলীবাবু এইমাত্র চলে গেলেন। যাবার সময় তাঁর বেলফুলের কথা মনে থাকল না, অবনীরও নয়। ফটক পর্যন্ত বিজলীবাবুকে এগিয়ে দিয়ে অবনী ফিরল।
আজ একটু বেশি রকম খাওয়া হয়ে গিয়েছে, চোখে পরিষ্কার কিছুই দেখতে পাচ্ছিল না অবনী, ঝাপসা গাছপালা, বারান্দার একটু আলো, অভ্যস্ত পথে এলোমেলো হেঁটে সিঁড়ির দিকে এগিয়ে যাচ্ছিল। ঠাণ্ডা বাতাসে দাঁড়াল সামান্য, পায়ে জোর পাচ্ছে না, হাত যেন কাঁপছে। সিগারেটের টুকরোটা অনাবশ্যক জোরে ছুঁড়ে ফেলে দিল। স্টেশনের দিক থেকে ভারী একটা শব্দ ভেসে আসছে মালগাড়ি চলে যাচ্ছে নিজের নিশ্বাস-প্রশ্বাস হঠাৎ কেমন কষ্টকর লাগল। মাথা তুলে আকাশ দেখার, অথবা ঊর্ধ্বমুখে নির্মল বাতাস টানার বাসনা হল, মাথা তুলতে গিয়ে অসম্ভব ভারী এবং বেসামাল লাগায় অবনী মাথা তুলল না। চোখের পাতা জুড়ে আসছিল।
সিঁড়ির কাছাকাছি আসতে সহসা তার মনে হল কে যেন ডাকল। দাঁড়াল অবনী। আস্তে আস্তে পিছন ফিরল। পরিষ্কার কিছু দেখা যাচ্ছে না, অল্প একটু আলো সামনে, তারপর অন্ধকার। কিছু সময় দাঁড়িয়ে থাকল অবনী, অপেক্ষা করল। না, কেউ নয়।
সিঁড়ি দিয়ে বারান্দায় উঠে হঠাৎ তার মনে হল, গলার স্বরটা তার চেনা। কার যেন, কার? ললিতার। অবনী সঙ্গে সঙ্গে আবার ঘুরে দাঁড়াল। যথাসম্ভব উজ্জ্বল চোখে তাকাল। না, কেউ না।