হাসতে লাগল অবনী। বিজলীবাবুও হাসলেন।
অবনী বলল, চলুন, বসা যাক।
মধ্যের ঘর দিয়ে পাশের এক ঘরে এল অবনী। ছোট, চৌকো ঘর; দুদিকে জানলা। বাতি জ্বলছিল। বসার জন্যে নিচু, গোটা তিনেক চেয়ার, এক পাশে কালো রঙের এক আর্মচেয়ার, একটা গোল সেন্টার টেবিল। একদিকে কাঠের ছোট একটি দেরাজ, বেতের বুককেসে কিছু এলোমেলো বই, দেওয়ালে একটি ক্যালেন্ডার।
ঘরে আসবাবপত্র যা আছে তা সামান্য হলেও এই ঘরের পক্ষে যথেষ্ট। অবনীর এটা ঠিক বসার ঘর নয়, অবসর সময় কাটানোর নিভৃত ঘর। পানাদি এই ঘরে বসেই করে থাকে অবনী।
বিজলীবাবু বসলেন। হাতের প্যাকেটের কাগজ খুললেন, একটা ভোয়ালে; তোয়ালে জড়ানো নতুন বোতলটি তিনি অবনীর দিকে বাড়িয়ে দিলেন। গয়া থেকে আনিয়েছি। …এ-সব জিনিস, বুঝলেন মিত্তিরমশাই, কখনও-সখনও এদিকে দু-একটা পাওয়া যায়। একেবারে গলা কেটে দাম নেয় বেটারা।
অবনী দেখল। হুইস্কি: ডিমপল স্কচ। বলল, ভাল জিনিস।
কুলীন।
বসুন, সোড়া আছে বোধ হয় দেখছি– অবনী চলে গেল।
বিজলীবাবু সিগারেট ধরিয়ে এপাশ-ওপাশ তাকালেন। একটা বই পড়ে ছিল, উঠিয়ে নিয়ে দেখলেন, রেখে দিলেন। ইলাস্ট্রেটেড উইকলির পাতা ওলটাতে লাগলেন বিজ্ঞাপনের মেয়েদের ছবি দেখলেন খুঁটিয়ে। চশমা খুলে মুছে নিলেন।
খেতে খেতে বিজলীবাবু বললেন, আরে, আপনাকে তো আসল খবরটা দিতেই ভুলে গিয়েছি, মিত্তিরসাহেব। …আজ কার দর্শন পেলাম বলুন তো?
কার–? অবনী সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে তাকাল।
সেই চোখের ডাক্তারনির…। এদিকে এসেছিল। ফিরছে। বাসে চাপল।
আমার সঙ্গে দেখা হয়েছে। অবনী বলল।
তাই নাকি? কোথায় দেখলেন? বিজলীবাবু উৎসাহ অনুভব করলেন।
রাস্তায়। বাড়ির কাছেই। …অফিস থেকে ফিরছিলাম, দেখা হল। …এদিকের একটি মেয়ের সঙ্গে এসেছিল।
মালিনী। …আরে, ওই তো প্রণবকুটিরের পাশ দিয়ে যে গলিমতন রাস্তাটা নেমে গেছে তার মধ্যে থাকে; শশধর বাঁড়ুজ্যের মেয়ে। বাপ মরে গেছে কবে। ওর ভাইটা তো আপনার অফিসে কাজ করে।
কে?
কেষ্ট। ভাল নামটা যেন কী..অনাদি-টনাদি হবে।
অবনী চিনতে পারল।
বিজলীবাবু বললেন, মেয়েটা সুরেশমহারাজের আশ্রমে থাকে আজকাল। বলে একটু থেমে অবনীর দিকে তাকিয়ে আবার বললেন, আপনাকে একবার বলেছিলুম মিত্তিরসাহেব, একটি মেয়ে দিচ্ছি রাখুন রান্নাবান্না করবে, ঘরদোর দেখবে…তা আপনি রাজি হলেন না। রাখলে আরামই পেতেন। ওই মেয়েটির কথা ভেবেই বলেছিলাম।
অবনী বিজলীবাবুর চোখ এবং মুখ দেখল।
বিজলীবাবু অপ্রতিভ হলেন না, বললেন, ওই সব মেয়ে, দেখতে দেখতে বর্ষার কলাগাছ হয়ে উঠেছে। বিজলীবাবুর চোখের তারা চিকচিক করে উঠল। ফেমিনাইন জেন্ডারের ওপর তেমন ভক্তি নেই কেন, মিত্তিরসাহেব?
অবনী কৌতুক অনুভব করল। বিজলীবাবু বরাবরই শব্দটা ওইভাবে বলেন। মাঝে মাঝে কথাটা জিজ্ঞেসও করেন। অবনীর ব্যাপারে তাঁর কোথাও যেন এক ধরনের কৌতূহল ও অবিশ্বাস রয়েছে। বিজলীবাবুর কাছে অবনী নিজের পারিবারিক পরিচয়টা এমনভাবে দিয়েছিল যাতে বিজলীবাবু কোনও কিছুই ঠিক মতন বুঝতে পারতেন না।
অবনী পাত্রটুকু শেষ করল। চাপা হাসি মুখে বলল, আপনার কী মনে হয়?
পাঁচ রকম সন্দেহ হয়
যেমন! অবনী সিগারেট ধরাল।
বিজলীবাবু মাথা নিচু করে অভ্যস্ত হাতে উভয়ের পাত্রে হুইস্কি ঢাললেন মাপমতন। সোড়া মেশাতে মেশাতে বললেন, কোথাও কোনও ব্রেকডাউন আছে নাকি?
অবনী হাসল। জোরে নয়।
অসুখ-বিসুখও তো আপনার থাকার কথা নয়। বিজলীবাবু এক টুকরো ওমলেট, কয়েকটা আদার কুচি মুখে দিলেন, দিয়ে চিবোতে লাগলেন। বিজলীবাবুর ধারণা, ডিমে উত্তেজনা বৃদ্ধি হয়।
অবনী অনেকটা ধোঁয়া গলায় টেনে নিল।
বিজলীবাবু বললেন, অনেকে শুদ্ধাচারী থাকতে ভালবাসে, সাধুসম্নেসী মানুষ-টানুষের কথা বলছি। তারা, মিত্তিরসাহেব, ব্রেহ্মচারী, বেটাদের সব তাতেই পাপ পাপ ভাব। …আরে–মুখ্য পাপ কীসের? পাপটা তুই দেখলি কোথায়? নপুংসক হয়ে জন্মেছি নাকি জগতে। বলবে, লালসা…। আলবাৎ লালসা. দেহের লালসা সখি পাপ বলে গণ্য করে যারা–একথা কি ভুলে যায় তারা সেলালসা সৃজিয়াছে নিজে ভগবান…।
বিজলীবাবু ওমর খৈয়ম আওড়াতে শুরু করেছেন। লালসা পাপ কি না বলা যায় না। তবে, অবনী ভাবল, লালসাও শেষ পর্যন্ত থাকে কোথায়? ভাবতে গিয়ে পানীয়ে তেমন জুত করে চুমুক দিতে না পেরে কেমন অস্বস্তি অনুভব করল।
মানুষের ইন্দ্রিয়গুলো কি বাক্সে তুলে রাখবার জিনিস, মিত্তিরসাহেব? বিজলীবাবুবড় করে একটা চুমুক দিলেন, দিয়ে সিগারেট ধরালেন, দেশলাই কাঠি কানে দিয়ে সুড়সুড়ি দিতে দিতে বললেন, মুখ, শালারা সব মুখ। আমি বোকা নয়, গাধার বাচ্চা নই। মুখ্যরাই এ জগতের মর্ম বোঝে না। আমার স্ট্রেট কথা, যে কদিন বেঁচেবর্তে থাকব, আমি শালা রাজার মতন থাকব। চোখ বুজলে কে কার আমাদের আসা-যাওয়া কে বা খোঁজ নেবে? সিন্ধুজলে বিন্দুসহ মিশে যাব সবে।
বিজলীবাবুর মুখের ভাবটা আস্তে আস্তে বদলে আসছে: ফরসা মুখের চামড়ায় সামান্য লালচে ভাব, কপালে কয়েক বিন্দু ঘাম, চোখ ঈষৎ অলস। চশমাটা তিনি খুলে ফেলেছেন।
অবনী হেসে বলল, ড্রিংক, ফর ওয়ানস ডেড, ইউ শ্যাল নেভার রিটারন…
উ… হ্যাঁ হ্যাঁ…নেভার রিটারন। মাথা ঝাঁকালেন বিজলীবাবু, ছেলেবেলায় পদ্য পড়েননি– সময় চলিয়া যায় নদীর স্রোতের প্রায়–যে জন না বোঝে তারে ধিক শত ধিক। আপনার সময় চলে যাচ্ছে…গ্রোয়িং ওলড়…; শেষ কালে আফশোস হবে মিত্তিরসাহেব।