হৈমন্তী কিছু বলল না, হাসল।
অবনী সামান্য অপেক্ষা করে আবার বলল, কেমন লাগছে নতুন জায়গা?
তাকাল হৈমন্তী, অবনী নিষ্পলক চোখে তাকিয়ে আছে, দৃষ্টিটা কৌতূহলের না কৌতুকের ঠিক বোঝা যায় না। মন্দ না।
বাইরে থেকে এসে প্রথম প্রথম ভালই লাগে—
হ্যাঁ, খুব ফাঁকা। জঙ্গলই প্রায়।
আপনাদের আশ্রম তা হলে ভালই চলছে! অবনী ঠাট্টা করছে কি না বোঝা গেল না।
চলছে হৈমন্তী সসঙ্কোচে হাসল সামান্য; আপনি তো কই আর এলেন না?
অবনী কিছু বলতে যাচ্ছিল, সংযত হল; বলল, যাব একদিন। সুরেশ্বরবাবুর নেমন্তন্ন আছে।
হৈমন্তী পিছন দিকে তাকাল। মালিনীর এখও দেখা নেই। কী যে করছে কে জানে।
অবনী লক্ষ করল: হৈমন্তী সামান্য অধৈর্য হয়ে উঠেছে। বলল, আমার বাড়িতে বসবেন খানিক?
না না, থাক; অন্য একদিন বসব। …বেড়াতে আমার ভালই লাগছে।
এভাবে রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকা যায় কতক্ষণ। অবনী বলল, চলুন তা হলে আপনাকে খানিকটা এগিয়ে দিই।
থাক না…আপনি অফিস থেকে ফিরছেন আবার এখন কষ্ট করে. হৈমন্তী আপত্তি জানাবার চেষ্টা করল।
কী আর কষ্ট, চলুন, আস্তে আস্তে হাঁটি–ততক্ষণে আপনার সঙ্গী এসে পড়বে। হাঁটতে হাঁটতে আবার বলল, কে এসেছে সঙ্গে–?
একটি মেয়ে, ওখানেই থাকে, বাড়ি এখানে।
অবনী তেমন কোনও মেয়েকে খেয়াল করতে পারল না। সুরেশ্বরের কি একটা নারী-আশ্রমও আছে নাকি? অবনী মনে মনে কৌতুক বোধ করল।
হৈমন্তী হঠাৎ শুধোল, আপনি এখানে অনেক দিন থেকেই আছেন?
না; দু বছর।
তবে তো অল্প দিনই। …কেমন লাগে আপনার?
খারাপ কী!
হৈমন্তী মুখ ফিরিয়ে অবনীকে লক্ষ করবার চেষ্টা করল। শেষে বলল, এদিকটা মন্দ নয়; লোকজন, হাটবাজার, আলো বেশ শহর-শহর ভাব। আমাদের ওদিকটায় একেবারে চুপচাপ। কলকাতা থেকে এসে মনে হয়, জলে পড়ে গিয়েছি! হৈমন্তীর হাসল।
অবনী হৈমন্তীকে দেখতে চাইল। এই আলোয় তেমন করে হৈমন্তীর চোখ দেখা যায় না। অবনী বলল, কোথায় থাকতেন কলকাতায়?
ভবানীপুর। …আপনিও কি কলকাতায়…
বাদুড়বাগানে। অবনী হাসল হঠাৎ, তারপর বলল, প্রায় বাদুড়ের মতনই।
হৈমন্তী কিছু বুঝল না, কিন্তু অবনীর হাসিটা কানে লাগল। কিছু না বুঝেও কেমন হাসির মুখ করল হৈমন্তী।
চুপচাপ আরও কয়েক পা এগিয়ে এসে অবনী বলল, আপনার ডাক্তারি কেমন চলছে?
এবারে হৈমন্তী হেসে ফেলল। অবনী এমন ভাবে কথাটা বলেছে যেন মনে হয় হৈমন্তী সদ্য একটা ডিসপেনসারি খুলে বসেছে। হৈমন্তী বলল, এখনও হাতযশ হয়নি।
অবনী বোধ হয় বুঝতে পারল, বুঝতে পেরে হালকা গলায় হাসল।
হৈমন্তী বেশ সপ্রতিভ হয়ে উঠেছিল। বলল, ডাক্তার উকিলদের কেমন পশার তা নাকি রুগি আর মক্কেলদের জিজ্ঞেস করতে হয়। আমার তো পশার নেই।
ছুটতে ছুটতে মালিনী এসে পড়েছে ততক্ষণে। এসে অবনীকে দেখে বোকা হয়ে গেছে যেন।
হৈমন্তী বলল, এতো দেরি তোমার!
মালিনী আড়ষ্ট, কোনও কথা বলল না। অবনী মালিনীকে দেখল। দেখা মুখ।
বাস পাব তো? হৈমন্তী শুধোল।
মাথা হেলিয়ে মালিনী জানাল, হ্যাঁ–পাওয়া যাবে।
অবনী ঘড়ি দেখল হাতের, এখনও মিনিট পনেরো আছে। তাড়াতাড়ি যান–পেয়ে যাবেন। আচ্ছা–
হৈমন্তী চঞ্চল হয়ে উঠল। অবনীর দিকে চকিতে তাকাল, আসবেন একদিন।
অবনী মাথা হেলিয়ে হাসল। যাব।
এগিয়ে এসে মালিনী সবিস্ময়ে শুধোল, ওঁকে আপনি চেনেন, হেমদি?
হৈমন্তী মালিনীর মুখ লক্ষ করল। হ্যাঁ, ওঁর গাড়িতেই আমরা সেদিন গিয়েছিলাম। কেন?
মালিনী জানে হেমদিরা প্রথম যেদিন আশ্রমে আসেন গাড়ি করেই এসেছিলেন। বাস খারাপ হয়ে যাবার গল্পও সে শুনেছে। কিন্তু জানত না অবনীর গাড়িতেই হেমদিরা এসেছিলেন। সে কাছে ছিল না, অবনীকেও দেখেনি।
মালিনী বলল, আমার ভাই ওঁর অফিসে চাকরি করে।
ও! হৈমন্তী বুঝতে পারল।
খানিকটা এগিয়ে এসে মালিনী বলব কি বলবনা করে আবার বলল, লোক কিন্তু ভাল না।
হৈমন্তী মুখ ফেরাল।
খুব মদটদ খায়.. মালিনী বলল।
মালিনীর মুখ দেখছিল হৈমন্তী, যেন তার চোখ বলছিল: কী করে জানলে তুমি?
মালিনী গলা একটু নামিয়ে বলল আবার, বাড়িতে একলা থাকে।
মালিনীর গলার স্বরে এমন এক ইঙ্গিত ছিল যা কানে খারাপ লাগে। হৈমন্তী হঠাৎ কেমন বিরক্তি বোধ করল মালিনীর ওপর, অসন্তুষ্ট হল।
ভর্ৎসনার মতন করে হৈমন্তী বলল, পরচর্চা করতে হবে না এখন, চলো।
মালিনী চুপ করে গেল।
.
সন্ধের পর বিজলীবাবু এলেন। এই সময়টা তাঁর পক্ষে সাইকেল নিয়ে ঘুরে বেড়াবার উপযুক্ত সময় নয়। যেদিনই আসেন হেঁটে আসেন, হেঁটেই ফেরেন।
হাতে কাগজে মোড়া একটা প্যাকেট, দেখলে মনে হয় কোনও জিনিস কিনে ফিরছেন। বাগানটুকু পেরিয়ে বারান্দায় ওঠার আগে বিজলীবাবু সিঁড়ির পাশের বেলঝাড় থেকে কয়েকটা বেলফুল তুলে নিলেন, তুলে ফুলের গন্ধ শুঁকতে শুঁকতে বারান্দায় এসে ডাকলেন–মিত্তিরসাহেব।
অবনী বেরিয়ে এল। আরে, এই যে আসুন–!
বিজলীবাবু ডান হাতের মুঠো থেকে বেলফুল দেখালেন। আপনার বাগানের বেলিফুলের খাসা গন্ধ তো, মিত্তিরসাহেব। মাটিতে কিছু দেন নাকি? বিজলীবাবু ইঙ্গিতপূর্ণ হাসি হাসলেন। যাবার সময় আরও কটা নিয়ে যাব। আমার দ্বিতীয়টির আবার লুকিয়েচুরিয়েও দু-চারটে বেল মাথায় গোঁজার শখ এখনও আছে।
অবনী হেসে ফেলল। যাবেন; পুরো বেলগাছটাই উপড়ে নিয়ে যেতে পারেন। বিজলীবাবু মজার মুখ করে মাথা নাড়তে নাড়তে বললেন, আমার বাড়ির মাটিটা তেমন সরেস নয় বুঝলেন মিত্তিরসাহেব, রসের মাটি থেকে দু-চারটে ফুলই ভাল।