কখন যেন বিকেল পড়ে গিয়ে আলো মুছে আঁধার জমছিল। গাড়ি অনেক দুর এসে পড়েছিল। তাকে পাশ কাটিয়ে, তার সামনে দিয়ে আরও কত গাড়ি চলে গেল। অবনী লক্ষ করল, অন্যমনস্কতার মধ্যেই সে কখন নিজের অজ্ঞাতেই গাড়ির হেডলাইট জ্বালিয়ে দিয়েছে। ঠাণ্ডা বাদলা বাতাস আসছে হুহু করে, গাড়ির পিছন দিকের ক্যানভাস বাতাসের দমকায় উড়ে উড়ে আছড়ে পড়ছে, কেমন এক শব্দ হচ্ছে যেন কেউ অবনীর পিছু পিছু বুক চাপড়াতে চাপড়াতে চলেছে। অসহ্য মনে হওয়ায় গাড়ি থামাল অবনী। শহরের দিকের বাসটা তার পাশ কাটিয়ে উলটো দিকে চলে গেলে ঘড়ি দেখল, প্রায় সাড়ে ছয়। এখনও অনেকটা পথ, মাইল পনেরোরও বেশি। গাড়ির ইঞ্জিনে কোথাও একটা বেয়াড়া শব্দ হচ্ছে। নামল অবনী, ইঞ্জিন দেখল। ঠিক বোঝা গেল না। একটা টর্চ আনা উচিত ছিল, সাধারণত সঙ্গে থাকে। আজ তাড়াতাড়ি হাসপাতালে যাবার সময় টর্চের কথা খেয়াল হয়নি। গাড়িতে ফিরে এসে উঠে বসার আগে পিছনের ক্যানভাস বাঁধার চেষ্টা করল, উঠে এসে সিগারেট ধরাল অবনী। কেমন একটা অবসাদ এসেছে, ছোটাছুটি করার জন্যে হতে পারে, মনের ভারের জন্যেও হতে পারে। প্রায় আধখানা সিগারেট চুপচাপ বসে বসেই শেষ করে গাড়িতে আবার স্টার্ট দিল, দিয়ে ডান দিকের পথ ধরল। মাইলটাক এগিয়েই মাখারিয়ার জঙ্গল শুরু হবে। পথটা সাবধানে পেরিয়ে যাওয়াই রীতি। জঙ্গলের দিকে বৃষ্টি হয়েছে কিনা বোঝা গেল না। বাসটার গায়ে জল ছিল, ঠিক কোথায় বৃষ্টি পেয়েছে কে জানে, জঙ্গলে বৃষ্টি থাকলে খুব সাবধানে এই পথটা পেরোতে হবে।
সাবধান হওয়া না হওয়ায় খুব কি একটা যায় আসে? হীরালাল কখনওই বেপরোয়া ছিল না। প্রতিটি কাজ সে ভেবেচিন্তে সাতপাঁচ ভেবে করত। ঠাণ্ডা মাথার লোক যেমন হয়। এই এলাকায় সে আজ চার বছর ওভারহেড ইলেকট্রিক লাইন লাগাবার তদারকি করছিল। জরিপনকশা, পথঘাট বন পাহাড় তার সব জানা, কাগজ পেনসিল দিলে চোখ বুজে ছক করে কোথায় কী আছে বলে দিতে পারত। অথচ সেই হীরালাল সামান্য একটা ট্রাক নিজের হাতে পথের পাশে সরিয়ে রাখতে গিয়ে কেমন করে যেন কালভার্টের পাশে গাড়িটাকে গড়িয়ে দিল, ঢালু পথে গাড়িটা মালপত্র সমেত উলটে গেল, হীরালাল জখম হল। প্রথমে মনে হয়েছিল, তার আঘাত গুরুতর নয়, শরীরের বাইরে তেমন একটা ভাঙাচোরা রক্তারক্তির চিহ্ন ছিল না। ছোকরা অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিল। হাসপাতালে নিয়ে যাবার পর জানা গেল, মাথায় জোর চোট লেগেছে, রক্তক্ষরণ হচ্ছে ভেতরে। আজ নিয়ে দুদিন ওই রকম, অজ্ঞান অবস্থা। আশা ভরসা আর নেই। বিন্দুমাত্রও নয়।
কেমন এমন হয়? কেন?
.
অবনী হঠাৎ অনুভব করল সে মাখারিয়ার জঙ্গলে ঢুকে পড়েছে, সন্ধ্যা হয়ে গেছে, এবং তার মাথার ওপর এক খণ্ড কালো ভয়ংকর মেঘ। থমথমে সেই মেঘের পুঞ্জ ক্রমশই ধোঁয়ার মতন কুণ্ডলী পাকিয়ে আকাশ ঢেকে ফেলতে চাইছে। জঙ্গলের মাথার ওপর দিয়ে যেন সাঁতার কেটে চলেছে মেঘটা। ক্রোধ, তিক্ততা, আক্রোশ সমস্তই যেন আচমকা অবনীকে কেমন বেপরোয়া করে তুলল। পাথরের মতন শক্ত হয়ে সে বুঝি কারও বিরুদ্ধে দাঁড়াতে চায়, অন্ধ হিংস্র দৃঢ় হয়ে। গিয়ার বদলে নিল। অ্যাকসিলারেটারে চাপ বাড়াতে লাগল, স্টিয়ারিং ধরল শক্ত মুঠোয়। তারপর মনে মনে অদৃশ্য কোনও শত্রুকে যেন ঘৃণার সঙ্গে কিছু বলল।
শাণিত তরোয়ালের মতন আলোর দীর্ঘ ফলা অরণ্য ও অন্ধকারকে চিরে পথ দেখিয়ে দিচ্ছিল, অবনী সাবধানে গাছের সারি বাঁচিয়ে, মাঝ বরাবর পথ ধরে, উঁচুনিচু লক্ষ রেখে, এবং প্রতিটি বিশ্রী বিপজ্জনক বাঁক অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে পেরিয়ে যাচ্ছিল। হঠকারিতা করে সে কখনও পথের পাশে সরছিল না। উভয় পাশেই বৃক্ষলতাকীর্ণ গভীর খাদ অন্ধকারে ফাঁদ পেতে রেখেছে, অসতর্ক হলে অবনী সেই ফাঁদে ধরা পড়বে। সম্ভবত বিকেলের দিকে বৃষ্টি হয়ে গেছে জঙ্গলে, কালো পিচের রাস্তা এখনও ভিজে, গাড়ির আলোয় দীর্ঘ কোনও সরীসৃপের পিচ্ছিল শরীরের মতন কুৎসিৎ দেখাচ্ছিল। রাস্তার দু পাশে দীর্ঘকায় প্রাচীন বৃক্ষ। অবনী জানে, অসাবধান হলে এই পথে গাড়ির চাকা পিছলে যেতে পারে, পিছলে গিয়ে সরাসরি গাছের সঙ্গে প্রচণ্ড ধাক্কা খেতে পারে। তার সে রকম কোনও স্পৃহা নেই। লক্ষ স্থির তীক্ষ্ণ রেখে, শরীরে অঙ্গগুলি অস্বাভাবিক কঠিন করে, দক্ষতার সঙ্গে সে পথ অতিক্রম করছিল।
যেতে যেতে কখন যেন অবনী অনুভব করল, তার চতুর্দিকের স্তব্ধতা ভয়াবহ হয়ে উঠেছে। গাড়ির ইঞ্জিনের শব্দ ছাড়া কোথাও কোনও রকম শব্দ নেই, সেই একঘেয়ে যান্ত্রিক শব্দও দীর্ঘ সময় কানের কাছে বাজতে বাজতে কখন যেন সয়ে গেছে, স্বতন্ত্রভাবে আর শোনা যায় না। এই নিরালোক অসাড় জগতের নৈঃশব্দ এক অবর্ণনীয় প্রাণহীনতা সৃষ্টি করেছে। অবনী হঠাৎ কেমন আতঙ্ক অনুভব করল।
তারপর সহসা তার দৃঢ়তা ভাঙল, যে অবজ্ঞা আক্রোশে সে অজ্ঞাত এক শত্রুর সঙ্গে যুঝতে নেমেছিল মনে হল–সেই অবজ্ঞা এখন তাকে উপহাস করছে। কপালে ঘাম ফুটল, মেরুদণ্ড সামান্য নুয়ে পড়ল। দ্বিধা ও সন্দেহবশে তার মনে হল, গাড়ির আলো ক্রমশই নিষ্প্রভ হয়ে আসছে, এবং সে যেন কোনও গুহার মাঝ বরাবর এসে আটকে পড়েছে। যে কোনও মুহূর্তেই আলোটুকু ফুরিয়ে যেতে পারে, যে কোনও মুহূর্তে সর্বগ্রাসী এই অন্ধকার ও অখণ্ড স্তব্ধতা তাকে আক্রমণ করবে। অবনী ভীত হয়ে অকারণে গাড়ির হর্নে হাত দিল। তীব্র তীক্ষ্ণ এক শব্দ সদ্য ভূমিষ্ঠের মতন যেন এই উদ্বেগের মধ্যে চিৎকার করে উঠল। …অবনী অনেকক্ষণ আর হর্ন বন্ধ করল না বন্ধ করতে তার সাহস হল না, নিতান্ত অন্তরঙ্গ সঙ্গীর মতন তাকে অনুভব করতে করতে এক সময় অর্ধবৃত্তাকার একটি বাঁক পেরিয়ে কাঠের সাঁকোর মুখে এসে হঠাৎ অনুভব করল কী যেন তার চারপাশ থেকে সরে যাচ্ছে। আরও সামান্য এগিয়ে সে বুঝতে পারল মাখারিয়ার জঙ্গল এবং সেই কৃষ্ণকায় মেঘের সীমানা সে অতিক্রম করে চলে এসেছে।