ডাক্তারি পাশ করার পর সুরেশ্বর আবার তাকে চোখের ডাক্তারি পড়ে নিতে লিখল। নিজেও এসেছিল একবার। হৈমন্তীর আর ইচ্ছে ছিল না। কিন্তু সুরেশ্বরের অনুরোধ ও ইচ্ছা সেনা রেখেও পারল না। ততদিন সুরেশ্বর গুরুডিয়ায় এসে বসেছে। হৈমন্তীকে তার প্রয়োজন ছিল।
হৈমন্তী ভেবেছিল, সে সুরেশ্বরের সমস্ত ইচ্ছা পূর্ণ করেছে, সুরেশ্বরও তার ইচ্ছা পূর্ণ করবে। কেন যে, আজকাল তার দ্বিধা এসেছিল, মনে হত সেই সুরেশ্বর–যে তাকে মৃত্যু থেকে জীবনে ফিরিয়ে এনেছে বিস্বাদ, বিবর্ণ, মুখে-মাছি বসা এক জগৎ থেকে–সে যেন আড়ালে কোথাও সরে যাচ্ছে। হৈমন্তীর এটা সহ্য হত না। মা বুঝতে পেরেছিল, সুরেশ্বরকে আর অকারণ কাছে টানার চেষ্টা। হৈমন্তী বোঝেনি, বুঝতে রাজি হয়নি। একরকম বেপরোয়া হয়ে, এবং কিছুটা আশা নিয়েই হৈমন্তী এসেছিল এখানে এসে দেখেছে, সুরেশ্বর অন্য মানুষ।
নিজের জীবনের জন্যে হৈমন্তী সুরেশ্বরের কাছে এত বেশি রকম কৃতজ্ঞ যে, কখনও ওই মানুষটিকে সে বেদনা দিতে চায়নি। এখনও চায় না। সুরেশ্বরকে আঘাত করলে বা তাকে পরিত্যাগ করলে সুরেশ্বর সহ্য করে নেবে, কিন্তু হৈমন্তীর মর্যাদা থাকবে না। সুরেশ্বর তাকে সমস্ত দিক থেকে ছোট, হীন করতে পারে না। যদি এমন হয়, সুরেশ্বর তার প্রতি করুণা করে এসেছে, যদি এমনও হয় যে সুরেশ্বর যে সাহায্য হৈমন্তীকে করেছিল আজ তার প্রতিদান চাইছে মনে মনে–তবু হৈমন্তী সুরেশ্বরকে এই মর্যাদার প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জিতে যেতে দেবে না। তুমি মহানুভব, উদার; আমি স্বার্থপর, ঋণী, প্রবঞ্চক–এই অহঙ্কার যেন তোমার না থাকে।
হৈমন্তী শুয়ে শুয়ে অনুভব করল দমকা প্রবল বাতাসে তার জানলার পরদা ফুলে উঠেছে, শব্দ হচ্ছে, যেন হঠাৎ পরদাটা ছিঁড়ে গিয়ে অবরুদ্ধ বাতাস ঘরে ঢুকে সব তছনছ করে দেবে।
.
০৫.
পথের মধ্যে দাঁড়িয়ে না থেকে হৈমন্তী একা একাই ধীরে ধীরে হেঁটে যাচ্ছিল। তার হাতে সামান্য কটা জিনিসপত্র, বাকি সবই মালিনীর কাছে। বাড়ি থেকে বেরিয়ে অল্প একটু এসেই মালিনীর কী যেন হল, অপ্রতিভ মুখে বলল: আমায় একবার বাড়ি যেতে হবে হেমদি; আপনি বেড়াতে বেড়াতে এগোন, আমি আসছি।
আশপাশ দেখতে দেখতে হৈমন্তী এগোচ্ছিল। বেশ লাগছে চোখে। পাথর বাঁধানো রাস্তা, দু ধারে অনেকটা তফাতে তফাতে কাঠের খুটির মাথায় ইলেকট্রিক তার টেনেছে, গাছগাছালিও কম নয়, পথের দু দিকেই ছাড়া ছাড়া বাড়ি, খোলামেলা, বাগান-টাগান আছে, খুব শৌখিন বাড়িগুলো একেবারে ফাঁকাফটক বন্ধ; নানারকম নাম। ছোটখাটো বাড়িগুলোতে মানুষজন আছে।
পাড়াটা খুবই ভাল, মালিনীদের বাড়ি অবশ্য খানিকটা পিছিয়ে, সদর রাস্তা থেকে চার পাঁচটা বাড়ি ভেতরে। এক সময় মালিনীর বাবা যখন বাড়ি করেছিলেন তখন নাকি এখানে লোক আসত না, তারপর হুড়মুড় করে কত পয়সাঅলা লোক এসে গেল, বাড়ি করল, ফেলে রাখল, ছুটিছাটায় আসা-যাওয়া করতে লাগল। কে জানত বলুন হেমদি, শেয়াল রাজার এত বড় লেজ গজাবে। …তবু রক্ষে বাবা এই মাথাগোঁজার জায়গাটুকু করেছিল, নয়তো আমরা রাস্তায় দাঁড়াতাম। কথাটা ঠিকই বলেছে মালিনী; হোক না কেন দু খুপরির ঘর, শ্যাওলা ধরা চেহারা, চিটদেওয়াল টালিছাওয়া বাড়ি–তবু তো বেচারিদের মাথা গোঁজার আশ্রয়। এই আশ্রয় ওদের কাছে কতটা তা ওরাই বোঝে।
রাস্তাটা ভাল, কিন্তু ধুলো ওড়ে বড়। এলোমেলো, ঘোট ঘোট ঘূর্ণি বাতাসে মাঝে মাঝে ধুলো উড়ছিল। হৈমন্তী নাকেমুখে রুমাল চাপা দিল না। কেন যেন ধুলোর গন্ধটা তার ভালই লাগছিল। শৌখিন বাড়িগুলোর ফটকে মাধবীলতা, জুই, আরও কত লতাপাতা। এক বাড়ির গেটের দুপাশে ইউক্যালিপটাস গাছ। লিকলিকে চেহারা, সোজা উঠে গেছে। হৈমন্তী গাছ দুটোর গা মাথা দেখতে গিয়ে আকাশ দেখল। চমৎকার এক টুকরো লাল মেঘ, হাঁসের মতন গড়ন। যেন পাখা গুটিয়ে ভাসতে ভাসতে চলেছে।
আরও কয়েক পা এগিয়ে এসে হৈমন্তীর হঠাৎ নজরে পড়ল, তার খুব কাছাকাছি, মুখোমুখি এক ভদ্রলোক, তার দিকে তাকিয়েই এগিয়ে আসছেন।
চেনা, নাকি চেনা নয়, কোথায় যেন দেখেছি, চোখ এবং স্মৃতি অকস্মাৎ ঘোলাটে হয়ে আবার পরিষ্কার হয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গে হৈমন্তী থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল। উলটো দিকের ভদ্রলোকও মুখের সামনে।
ঈষৎ বিমূঢ়তা এবং অস্বস্তি যেন উভয়পক্ষই অনুভব করল।
আপনি! অবনী বিস্মিত হয়ে বলল।
হৈমন্তীর তখনও পুরোপুরি বিমূঢ়তা কাটেনি। ইতস্তত ভাব করল। এই তো
এদিকে কোথায়? অবনী স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকল।
একজনের সঙ্গে এসেছিলাম– হৈমন্তী ঘাড় ঘুরিয়ে পেছনের দিকে দূরের পানে ইঙ্গিত করল; তারপর হাসবার মতন মুখ করে বলল, একটু কাজে সে বাড়ি গিয়েছে, আসবে এখুনি। …আপনি এখানে?
অবনী হাত বাড়িয়ে রাস্তার পাশে একটা বাড়ি দেখাল, বলল, আমার বাড়ি। অফিস থেকে ফিরছি।
হৈমন্তী মুখ ফিরিয়ে বাড়িটা দেখল। একেবারে তার ডান পাশে। বাগান খানিকটা, তারপরই বাড়ি, বারান্দা দেখা যাচ্ছে।
হৈমন্তী কী বলবে ঠিক করতে না পেরে সাধারণ আলাপ করার গলায় বলল, এদিকে বেশ ভাল ভাল বাড়ি দেখছি।
তা দেখবেন। কিছু পয়সাঅলা লোক আছে, বাড়ি করে রেখেছে, এখানে থাকে না, ছুটিতে আসে। …তবে, এদিকের অ্যারিসট্রোকেট পাড়া ওপাশে, কলকাতা-পাটনার ধনী ব্যক্তিদের ব্যাপার… অবনী হাসির মুখ করল। কী ভেবে লঘু সুরে অবনী আবার বলল, আমি কিন্তু বাড়ির মালিক নই, ভাড়াটে।