তা ছাড়া উনি ততদিনে মারাও গেছেন। মার কাছে শুনেছে হৈমন্তী, মৃত্যুটা নাকি স্বাভাবিক ছিল না। সুরেশ্বরের যখন বছর ত্রিশ বয়েস ওর বাবাও মারা গেলেন। হৈমন্তীদের কলকাতার বাড়িতে সুরেশ্বরের আসা-যাওয়া তখন থেকেই বাড়ে, তার আগে কলেজে পড়ার সময় কয়েক বছর নিয়মিত আসা-যাওয়া করলেও মধ্যে কয়েক বছর সুরেশ্বর তেমন আসেনি, তখন সে কলকাতায় থাকত না। বলতে গেলে হৈমন্তী প্রথম কৈশোরে কিছু দিন সুরেশ্বরকে বাড়িতে আসতে যেতে দেখেছিল, তারপর দেখল বছর পাঁচ পরে, যখন সে কৈশোর উত্তীর্ণ হয়ে যৌবনে পা দিয়ে দাঁড়িয়েছে। আগের দেখাটা তেমন যদি নাও হয়, তবে বিরতির পর নতুন করে সুরেশ্বরকে দেখাটা হঠাৎ যেন কিছু আবিষ্কারের মতন। তখন যে কী হয়েছিল আজ আর তা মনে করতে পারে না হৈমন্তী, শুধু মনে পড়ে নিজের শরীরের ছায়া যেমন সর্বক্ষণের সঙ্গী, সুরেশ্বরের চিন্তাটাও তেমনই তার চেতনা-অর্ধচেতনার মধ্যে সর্বদা বিরাজ করত।
তারপর যা ঘটল সেটা যেন বজ্রপাত। কোথাও কোনও মেঘ না, আভাস নয়, জ্বর গায়ে ব্যথা যন্ত্রণা নিয়ে শুয়ে হৈমন্তী হঠাৎ একদিন মাঝরাতে ঘুম ভেঙে বসে কাশতে কাশতে রক্তবমির মতন রক্ত ফেলল। তারপর অল্প অল্প। ডাক্তার মুখ ভার করল। মামা বেচারি ভয়ে ভাবনায় নীল। মা সারাক্ষণ বিছানার পাশে বসে। সুরেশ্বর ছিল, ছোটাছুটি শুরু করল।
তিন চারটি সপ্তাহ সবাই উদ্বেগের মধ্যে বসে থাকল। কী হয়েছে সঠিক করে বলার সাহস যেন কারও নেই। শেষে বোঝা গেল ব্যাধিটা রাজব্যাধি। বড় ভাইচা বাগানে চাকরি করত, বিয়ে করেছিল চার-আনি মেমসাহেব। মনি-অর্ডারে শদুই টাকা পাঠিয়ে কর্তব্য শেষ করল। অন্য ভাই ছোট, স্কুলে পড়ে। মামার উপার্জনেই সংসার চলত। বিয়ে-থা করেননি মামা। কিন্তু তাঁর উপার্জন এত নয় যে, ডাক্তারদের পরামর্শ মতন রাজচিকিৎসা হতে পারে।
এ-সময় যা করার সুরেশ্বরই করেছিল। বল, ভরসা, আশা বলতে সে ছিল বারো আনা। প্রথমে বাড়িতে সাময়িক চিকিৎসা, বাইরের হাসপাতালে দেড় বছর, আবার বাড়ি, শেষে কিছুদিন ঘাটশিলায় থেকে তবে হৈমন্তী মুক্তি পেল।
এই ব্যাধি হৈমন্তীকে দুটো জিনিস দিয়েছিল: সুরেশ্বরের প্রতি অসীম কৃতজ্ঞতা ও প্রেম, আর সে অনুভব করেছিল সংসারের আর পাঁচটা সাধারণ মেয়ের মতন কর্মক্ষম না হতে পারলে তার হীনতাবোধ সে অতিক্রম করতে পারবে না।
সুরেশ্বর বলল, ডাক্তারি পড়তে। এক সময়ে হৈমন্তীর ওটা সাধ ছিল। পড়ার কথা উঠলে মা আপত্তি করল। মামাও সন্দেহও করল শরীরে কুলোবে কি না। যে ডাক্তার হৈমন্তীকে সাময়িক চিকিৎসা করেছিলেন তিনি বললেন, চমৎকার পারবে। না পারলে আত্মবিশ্বাস হারাবে, পারলে তুমি জিতে গেলে। তা ছাড়া তোমার শরীর তো চমৎকার হয়েছে।
হৈমন্তী জীবন ফিরে পেয়ে তাকে পুনৰ্ষত করতে চায়নি; আবার এখন ঠিক ডাক্তারি পড়তেও নয়, অন্য কিছু হলে ভাল হত। সুরেশ্বরের আগ্রহে সে ডাক্তারি কলেজে ভরতি হল। যেন সুরেশ্বরের মনোবাসনা বা শখ পূর্ণ করাতেই সে বাধিত হবে।
অসুস্থতার দু-আড়াই বছর হৈমন্তী যে সুরেশ্বরকে দেখেছে সে সুরেশ্বর হৈমন্তীর নিকটাত্মীয়েরও অধিক। সুরেশ্বরের জীবন যেন তার মরা বাঁচার ওপর নির্ভর করেছে। হেম বেঁচে থেকে সুরেশ্বরকে বাঁচিয়ে রেখেছে, সুরেশ্বরও হেমের আয়ু-দীপ হয়ে থেকেছে।
হেম, তুমি সবসময় বাঁচার ব্যাকুলতা নিয়ে বাঁচবে, ব্যাকুলতা ছাড়া বাঁচা যায় না। ..হেম মনে কখনও সন্দেহ এনো না সন্দেহ করে বাঁচা যায় না। সুরেশ্বর এই সব বলত, চিঠিতে লিখত। ছুটে ছুটে দেখতে যেত হাসপাতালে অশেষ কষ্ট করে, বলত: দুর…একটা রাত জাগা কি কষ্ট নাকি! তোমাকে দেখতে আসছি ঘুমটুম চোখের দশ হাত দূরে থাকে। বা, অনেক ইম্প্রভ করেছ। মার্ভেলাস!
ঘাটশিলায় বাড়ি নিয়ে থাকার সময় মা ছিল, আর সুরেশ্বর। শীতের সকালে গরম কাপড়ে সতর্কে ও সাবধানে হৈমন্তীকে ঢেকে নিয়ে সুরেশ্বর বেড়াতে যেত। দুপুরে গ্রামোফোন বাজিয়ে শোনাত, গল্পের বই পড়ত, বিকেলে আবার বেড়াতে নিয়ে যেত, সন্ধেবেলায় কত রকম গল্প। এই সাহচর্য এবং সঙ্গ এত অন্তরঙ্গ ও উষ্ণ ছিল যে, হৈমন্তীর মনে হত তার বসনে, অঙ্গে, হৃদয়ে এবং ত্বকেও যেন সুরেশ্বরের সর্বক্ষণ স্পর্শ আছে।
হৈমন্তী যখন আর অসুস্থ নয়, রাহুমুক্ত, জীবনের স্বাদ উপভোগ করে প্রতিনিয়ত সুখী, নির্ভার, নিশ্চিন্ত, ডাক্তারি কলেজে পড়তে ঢুকেছে তখনও সুরেশ্বরকে দেখে বোঝা যেত না তার দিক থেকে হৈমন্তীর প্রতি কোনও উপেক্ষা আছে।
ডাক্তারি পড়ছে যখন হৈমন্তী-মাঝামাঝি–তখন সুরেশ্বর কলকাতা ছাড়ল। বলল, একটু বেড়িয়ে আসি। মাস দুই পরে ফিরল, তারপর আবার বাইরে গেল, বলল: একটা কিছু করব ভাবছি, দেখি। কলকাতা আর ভাল লাগছে না। তখন থেকেই সুরেশ্বর কেমন যেন। আসে, আবার চলে যায়। চাকরি বাকরিতে ওর কোনওকালেই গা ছিল না। কখনও এটা করত, কখনও সেটা।
এই যে সুরেশ্বর কলকাতা ছেড়ে উধাও হত, দুচার ছ মাস আর আসত না, কিন্তু যোগাযোগ নষ্ট করত না। চিঠিপত্র লিখত। হৈমন্তী এটা পছন্দ করত না। সুরেশ্বরের অদর্শন প্রথম প্রথম তাকে ব্যথিত ও চিন্তিত করত। পরে সহ্য হয়ে গেল। পড়া প্রায় শেষ হয়ে এসেছিল, ছেড়ে দিতেও ইচ্ছে হত না, অথচ যার জন্যে এত আগ্রহ করে পড়া সে কাছে না থাকায় মন বিমর্ষ থাকত।