অভ্যাস মতন অল্প একটু পথ এগিয়ে দিয়ে সুরেশ্বর দাঁড়াল, হৈমন্তী আর দাঁড়াল না, এগিয়ে গেল। পিছন দিকে তাকাবার ইচ্ছেও তার ছিল না, ইচ্ছাকৃতভাবে দ্রুত হাঁটার চেষ্টা করল। ব্যর্থতার অনুশোচনা অথবা গ্লানির মতন তার মনে বিরক্তি জমছিল।
এইরকমই হচ্ছে প্রায়। এখানে আসা পর্যন্ত হৈমন্তী মাঝে মাঝে অত্যন্ত হতাশ ও বিমর্ষ হয়ে পড়ছে। এখন তার বিন্দুমাত্র ভাল লাগছিল নাঃ সুখ না, তৃপ্তি না, স্বস্তিও নয়। নিজের ওপরেই সে অসন্তুষ্ট, বিরক্ত হয়ে উঠছিল।
কোনও কিছু লক্ষ না করে ঝোঁকের মাথায় খানিকটা পথ হেঁটে এসে হৈমন্তী দাঁড়াল। সামনে হাসপাতাল-ঘর চোখ তুলে দেখল, দেখে বিতৃষ্ণা অনুভব করল। নিজের সঙ্গে এই হাসপাতালের কোনও রকম সম্পর্ক আছে বলেও তার মনে হল না।
কয়েক মুহূর্ত দাঁড়িয়ে থেকে হৈমন্তী অন্য দিকে মুখ ফেরাল, তারপর ফিরতে লাগল। মা জানতে চেয়েছে, তারপর হৈমন্তী কী করবে? স্পষ্ট করে মা ঠিক সে কথাটা বলেনি, তবে মার কথার ওই রকমই মানে দাঁড়ায়, তুমি বরাবরই তোমার মতে কাজ করলে, আমার কোনও কথাই শুনলে না। এখনও যদি তুমি তোমার ভালমন্দ না বোঝ আর কবে বুঝবে। তোমার বেশ বয়েস হয়েছে, এভাবে ভেসে বেড়ানো আমার আর পছন্দ নয়।
মার চিঠির আরও কোনও কোনও কথা মনে পড়ায় হৈমন্তী অতি তিক্ত অসন্তোষ অনুভব করল। সুরেশ্বর শিশু নয়, অজ্ঞান নয়। হৈমন্তী কেন এখানে এসেছে সুরেশ্বর যে বোঝে না তাও নয়। এই আশ্রম বল, আদর্শ বল, এর ভালমন্দ কিছু থাক তা সুরেশ্বরের। অন্ধ-আতুরের সেবার জন্যে হৈমন্তী এখানে আসেনি। ডাক্তারিটা তার পেশা, জীবন-নয়। এই পেশার জন্যে হৈমন্তীর মাথা ব্যথা ছিল না, এখনও নেই। যদি সে পেশার জন্যে কাতর হত, তবে এখানে এই জঙ্গলে আসত না, কলকাতায় থাকত; তাতে রোজগার হলে হত, না হলেও সে মরে যেত না।
সুরেশ্বর সমস্তই বোঝে। বোঝে বলেই নিজের প্রয়োজন মেটাতে হৈমন্তীকে এখানে এনেছে। অথচ কত নিস্পৃহ হয়ে বলতে পারল, হৈমন্তীর যদি এখানে ভাল না লাগে–সে চলে যায়, সুরেশ্বর তাকে আটকাবে না।
মানুষ কত বদলে যায়। আজকের সুরেশ্বরকে দেখলে হৈমন্তীর অতিপরিচিত সেই সুরেশ্বরকে আর চেনাই যায় না।
হৈমন্তী চোখ তুলল; বাড়ির সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। মালিনী বারান্দায় বসে আপনমনে গান গাইছে, সন্ধেবেলায় মাঝে মাঝে সে এইভাবে গান গায়। মালিনীর গলা মেঠো, কিন্তু মিষ্টি। গানের সুরটা শুধু হৈমন্তীর কানে গেল, কী গাইছে বুঝল না, শোনার আগ্রহও অনুভব করল না। মুখ তুলে আকাশের দিকে তাকাল হৈমন্তী, তারায় তারায় ভরা, চোখের মণির মতো কালো যেন আকাশটা।
ঠাণ্ডা বাতাসে সামান্য সময় দাঁড়িয়ে থাকল হৈমন্তী। মালিনী গান থামাল, কী যেন বলল, হৈমন্তী অন্যমনস্কতাহেতু শুনতে পেল না। অন্ধকারে কোথাও কিছু উড়ে গেল, কোনও পাখি, সে বারান্দায় উঠে এল।
মালিনী অল্প তফাত থেকে বলল, বৃষ্টি বাদলার দিনে অন্ধকারে মাঠে অত ঘুরবেন না, হেমদি।
হৈমন্তী কোনও জবাব দিল না।
ঘরের দরজায় শিকল তোলা ছিল, খুলে ভেতরে এল হৈমন্তী। লণ্ঠন জ্বলছে মিট মিট; সবই অস্পষ্ট। জানলার কাছে এসে দাঁড়াল, তারপর বিছানায় গিয়ে বসল; শেষে গা এলিয়ে বিছানার পাশে পা রেখে শুয়ে পড়ল।
সুরেশ্বর এ-রকম ছিল না। বড় বেশি রকম পরিবর্তন হয়েছে। স্বাভাবিক পরিবর্তন নয়, অস্বাভাবিক। হৈমন্তী এতটা কল্পনা করেনি, চিন্তাও করেনি। আজ সুরেশ্বরকে দেখলে বা তার কাছাকাছি বসলে হৈমন্তীরই সন্দেহ হয়, ওই মানুষটি এক সময় দিবারাত্র হেম হেম করেছে কি না! তখন মনে হত, হেম ছাড়া সুরেশ্বর কিছু ভাবতে পারে না।
হৈমন্তীর বুকের তলায় সব যেন আস্তে আস্তে অসাড় হয়ে আসছিল, এবং অদ্ভুত এক শূন্যতা সৃষ্টি হচ্ছিল। এই শূন্যতা এত বেশি রকম নিজস্ব যে একমাত্র অস্পষ্টভাবে অনুভব করা যায় মাত্র, বলা যায় না, চিন্তা করা যায় না।
কিশোরী বয়স থেকে হৈমন্তী সুরেশ্বরকে দেখছে। তখন সুরেশ্বরর বয়স কম ছিল, সমস্ত চেহারার মধ্যে অত্যন্ত স্বচ্ছ নির্মল এক সৌন্দর্য যেন মাখানো থাকত, দেখতে ভাল লাগত, মন প্রসন্ন হত। চরিত্রে কোথাও এমন এক মিষ্টতা ছিল সুরেশ্বরের যা সকলকেই আকর্ষণ করত আনন্দ দিত। মামা ঠাট্টা করে বলতেন, ছোকরা সুর অসুর নয়–একেবারে সুরাসুর।
সুরেশ্বর পুরোপুরি সুপুরুষ ছিল না। তবে সুদর্শন ছিল। ওর মা অসামান্য সুন্দরী ছিলেন। মার সেই রূপ সুরেশ্বর পায়নি, মুখের সৌন্দর্যমাত্র পেয়েছিল। যেন ওর মা ইচ্ছাকৃতভাবে সন্তানকে নিজের সবটা দিতে চাননি, দিলে সুরেশ্বরের অমঙ্গল হত। বাবার মতনই ময়লা রং পেয়েছিল ও; বাবার মতনই মাথায় কিছুটা খাটো ছিল, দোহারা গড়ন। নিতান্ত পুরুষ বলে সুরেশ্বরের মুখে সৌন্দর্য ছিল, লাবণ্য ছিল না। লাবণ্য থাকলে তাকে মেয়ে বলেও মনে হতে পারত। জোড়া ভুরু, টলটলে দুটি চোখ, মণি ঈষৎ নীলচে, কোমল, নিবিড় দৃষ্টি, নিখুঁত দুটি ঠোঁট। সুরেশ্বরের তখন যৌবন। সুরেশ্বর সামনে এলে হৈমন্তীর মনে হত, খোলা জানলা দিয়ে যেন আলো বাতাসভরা এক সকাল এসেছে।
সেই সুরেশ্বর দেখতে দেখতে বয়সের বাহ্য চাঞ্চল্য কাটিয়ে উঠল। হৈমন্তীও কিশোরী বয়স উত্তীর্ণ হয়েছে। সুরেশ্বরের সঙ্গে তাদের পারিবারিক সম্পর্ক যা সেটা নিকট আত্মীয়তার নয়; হৈমন্তীর মা দূর সম্পর্কে সুরেশ্বরের মার বোন হতেন। যোগাযোগও বড় একটা ছিল না শেষের দিকে। থাকার কথাও নয়। হৈমন্তীরা কলকাতায়, সুরেশ্বরের মা দেশের বাড়িতে।