সুরেশ্বর হৈমন্তীর দিকে তাকিয়েছিল। কী যেন দেখছিল। লণ্ঠনের আলো এখনও তেমন করে ফুটে ওঠেনি, অন্ধকার কিছুটা হালকা।
তোমার মুখের সঙ্গে মাসিমার মুখের খুব মিল আছে। সুরেশ্বর বলল।
কথাটা সুরেশ্বর কেন বলল হৈমন্তী বুঝতে পারল না। মার সঙ্গে তার মুখের মিল যেটুকু আছে সেটুকু আদলে, আর কোথাও নয়।
মার সঙ্গে আমার অমিলও অনেক– হৈমন্তী হঠাৎ বলল, বলে হাসবার চেষ্টা করল।
সুরেশ্বর অস্বীকার করল না, ঘাড় হেলিয়ে জবাব দিল, তা তো থাকবেই। সুরেশ্বরও হাসল।
হৈমন্তী হাত বাড়িয়ে লণ্ঠনটা সরিয়ে রাখল সামান্য। কেরাসিন তেলের গন্ধ এখনও তার নাকে লাগে। বলল, এখানে কোনওদিন আলো হবে না, না?
কীসের আলো? সুরেশ্বর অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিল, কথাটা খেয়াল করেনি।
ইলেকট্রিক।
তোমার খুব অসুবিধে হচ্ছে।
আমার সুবিধের জন্যেই কি লাইট হবে। …এমনি জিজ্ঞেস করছি। এখানে ইলেকট্রিক হবার আশা নেই, না?
এখন নয়। দু-চার বছরের মধ্যেও হবে না। তারপর যদি হয়।
হৈমন্তী অতটা দুরের কথা ভাবতে পারল না। সমস্ত জিনিসই কি পাঁচ সাত দশ বছরের পরের চেহারা নিয়ে ভাবা যায়। এভাবে সে অনেক ভেবেছে, আর নয়।
সুরেশ্বর বলল, পাঁচ জায়গা থেকে কুড়িয়ে আমায় দিন চালাতে হয়, আলো করার পয়সা কোথায়, হেম।
হৈমন্তীর ইচ্ছে হল বলে, কেউ তোমায় কুড়োতে বলেনি, তুমি নিজেই হাত পেতে কুড়োতে এসেছ।
অভাব জিনিসটা– সুরেশ্বর একটু হেসে বলল, ভয়ের মতন; যত ভাববে তত বাড়বে।
এধরনের অর্থহীন কথা হৈমন্তীর পছন্দ হল না। ঠাট্টার গলায় বলল, তবে আর কী, মানুষকে কিছুই বোধ করতে হবে না, খিদে পেলেও নয়, অন্ধকারে থাকলেও নয়, কিছুতেই নয়।
আমি অমন বাড়াবাড়ির কথা বলিনি। যা পেলে মোটামুটি আমার প্রয়োজন মেটে তার বেশি চাইলেই মুশকিল হয়।
মোটামুটিই বা কজনের মেটে! …তা ছাড়া সব অভাবই তো খাওয়া পরার নয়– হৈমন্তী বলল। মনে পড়ল: মালিনীর যে অভাব সে-অভাব কীসের কে বলতে পারে। আমি কোন অভাব বোধ করি তুমি কী করে বুঝবে?
সুরেশ্বর মাথা নাড়ল আস্তে করে। কী ভাবছিল কে জানে। সামান্য সময় চুপচাপ, তারপর বলল, সংসারটা সুখের নয় হেম; জগৎটাও নিখুঁত নয়। অ-সুখের সংসারেই আমাদের জন্ম, খুঁতখুঁতুনি থাকবেই। …আমার মনে হয়, আমরা অনেক জিনিস ঢাক পিটিয়ে চাই, যেন সেগুলো ফেরার হয়েছে, কোতোয়ালিতে ধরে এনে দিতে হবে।
হৈমন্তী কিছু বুঝল না; বলল, সংসারে সবাই সুখ চায়।
তা তো চাইবেই।
তবে?
সুখের কোনও চেহারা নেই। যে যেমন করে তাকে গড়ে নেয়।
তাই বা পায় কোথায়?
না পেলে উপায় নেই।
হৈমন্তী চকিতের জন্যে সুরেশ্বরের দিকে তাকাল। এই নিস্পৃহতা সুরেশ্বরের চরিত্রে কিছুটা নতুন। আগেও ছিল, তবে এভাবে নয়। অথচ সংসারের সমস্ত ব্যাপারে সুরেশ্বরের এই নিস্পৃহতা তো এখনও নেই। শুধু…।
সুরেশ্বর নিজের থেকেই বলল, তুমি এখানে এসেছ, আমার পক্ষে সেটা মস্ত লাভ। আমি একটু স্বার্থপরের মতন কথা বলছি। যদি এখানে থাকতে তোমার ভাল না লাগে, আমি তোমায় জোর করে আটকে রাখব না! তোমায় যদি আমরা না পাই উপায় কী বলল। আমাদের হাতে সব কিছু তো থাকে না—হাতের বাইরেও থাকে।
হৈমন্তী কোনও কথা বলল না। কোথায় যেন সে অনুভব করল, সুরেশ্বরের কাছে আজ তার মূল্য আশ্রমের ডাক্তার হিসেবে। এর বেশি–এর বাইরে সুরেশ্বর কিছু ভাবে না নাকি?
কোনও কোনও মানুষ আছে যারা অনেকটা আয়নার মতন, তাদের নিজের কিছু দেখা যায় না। সুরেশ্বরকে অনেক সময় হৈমন্তীর ওই রকম মনে হয়। মানুষটির সামনে দাঁড়ালে নিজেকে শুধু প্রতিফলিত দেখা যায়। কখনও কখনও হেমন্তী অধৈর্য হয়ে ওই আয়নাতে বোকার মতন আলো ফেলে ভেতরটা দেখতে গিয়ে দেখেছে নিক্ষিপ্ত আলোর ঝলকটাই ফিরে আসছে। সুরেশ্বর কি এখন এইরকম এক সুদৃশ্য আয়না হয়ে থাকবে।
হৈমন্তী বিরক্তি বোধ করল। সুরেশ্বর তার কাছে যদি একেবারেই অপরিচিত হত তবে অন্য কথা। তুমি অচেনানও, অজানাও নয়–মনে মনে হৈমন্তী বলল: এক সময় আমি তোমার অনেকটা দেখেছি। তখন তুমি আরশি ছিলে না।
হৈমন্তী বলল, কী জানি, আমার এত ভাল লাগে না।
কী? সুরেশ্বর মুখ ফিরিয়ে তাকাল।
হৈমন্তী সরাসরি কোনও জবাব দিল না, বলল, সব মানুষই নিজের কথা ভাবে।
পরের কথাও ভাবে। সুরেশ্বর শান্ত, কেমন এক হাসির গলায় জবাব দিল।
নিজের ভাবনা বাদ দিয়ে নয়।
সুরেশ্বর আর কোনও জবাব দিল না। পরে এক সময়ে বলল, তা ঠিক।
হৈমন্তীর ইচ্ছে হল না অকারণ কথা বাড়ায়। আরও অল্পক্ষণ বসে থাকল চুপচাপ। তারপর বলল, আমি উঠি।
উঠবে কেন, আর খানিকটা বসো।
মার চিঠিটা লিখে রাখি গিয়ে, সকালে সময় পাব না।
কাল হাটবার, তোমার খাটুনি বাড়বে।
ওদের কথাবার্তা আমি বুঝতে পারি না কী যে বলে।
যুগলবাবুকে বলল, বুঝিয়ে দেবে।
উনিই দেন।
যুগলবাবু কম্পাউন্ডার গোছের মানুষ। হাসপাতালের কাজকর্ম প্রায় সবই দেখাশোনা করেন। এখানে থাকেন না। সাইকেলে যাওয়া-আসা করেন।
হৈমন্তী উঠে দাঁড়াল। সুরেশ্বরও উঠল। হৈমন্তী আপত্তি করতে যাচ্ছিল। সুরেশ্বর অল্প একটু পথ তাকে এগিয়ে দেবে, দিয়ে ফিরবে, কিংবা পায়চারি করে বেড়াবে মাঠে। এরকম সৌজন্য অকারণ।
নীচে নামল হৈমন্তী, সুরেশ্বরও নেমে এল পেছনে।
হাঁটতে হাঁটতে সুরেশ্বর বলল, কাল সকালে আমি টাউনে যাব। সরকারি একটা গ্রান্ট পাওয়া যাবে শুনছি। দেখি…।