সুরেশ্বর এল। তুমি না আজ স্টেশনের দিকে বেড়াতে যাবে বলেছিলে। গেলে না?
আজ হল না। কাল পরশু যাব।
সুরেশ্বর বেতের চেয়ারটা হৈমন্তীর দিকে এগিয়ে দিল, বসো৷ নিজে ক্যাম্বিসের চেয়ার টেনে নিল। বসল।
হৈমন্তী বসতে বসতে বলল, আজ মার আর-একটা চিঠি পেয়েছি।
কী লিখেছেন?
ওই কেমন আছি, কেমন লাগছে।
মাসিমার ধারণা আমরা বনেজঙ্গলে আছি, বাঘভালুকের মধ্যে, সুরেশ্বর সহাস্যে বলল। আমায় কতবার করে যে সাবধান করে দিয়েছেন।
আবার চিঠি দিয়েছে মা? হৈমন্তী সুরেশ্বরের চোখের দিকে তাকাল। মা যে কখন কী লিখে ফেলবে কে জানে!
না না; আগের চিঠির কথাই বলছি।
হৈমন্তী চোখ ফিরিয়ে নিল। মার খুব আপত্তি ছিল হৈমন্তী এখানে আসে। মা এ-সব গোড়াগুড়ি থেকেই চায়নি। ডাক্তারি পড়ার সময়ে নয়, তারপর এই চোখ নিয়ে আবার সময় নষ্ট, এখানে আসা। কোনওটাতেই মার ইচ্ছে ছিল না। কী হবে? এই যে পড়ছ আর পড়ছ, কী হবে তোমার?
মার অনিচ্ছাসত্ত্বেও সব হয়ে আসছিল হৈমন্তীর; এখানে আসার বেলাতেও মার অমতে এসেছে।
সুরেশ্বর আগের প্রসঙ্গেই বলল, আমাদের অনেক অহেতুক ভয় থাকে।
হৈমন্তী কিছু বলল না। মনে মনে ভাবল: যে বলছে হয়তো তারও আছে।
সুরেশ্বরের ঘরের মধ্যে নড়াচড়ার, এটা ওটা সরিয়ে রাখার এবং পায়ের শব্দ শুনতে পাওয়া যাচ্ছিল। ঘরের কাজ করছিল ভরতু।
সুরেশ্বর বলল, তুমি আমার মাকে দেখনি, হেম। আমার মার বরাবর ভয় ছিল আমি নির্ঘাত একদিন তেতলার ছাত থেকে পড়ে যাব। মার হুকুমে তেতলার ছাতের দরজায় তালা দেওয়া থাকত।
সুরেশ্বরের মাকে হৈমন্তী দেখেনি। দেখার কথাও নয়। গল্প শুনেছে নানারকম। বরাবরই নাকি একটু পাগলাটে ভাব ছিল; পরে বেশ পাগল হয়ে যান।
হৈমন্তী বলল, সব ভয়েরই একটা কারণ থাকে।
সুরেশ্বর হৈমন্তীকে লক্ষ করল। বলল, থাকে। ভয়ের ধারণা থেকে ভয় হয়। বনে জঙ্গলে বাঘ থাকে এই ধারণা থেকেই মানুষের জঙ্গলে ভয়। কিন্তু সব সময় তো তা সত্যি নয়। আমি এখানে যতদিন আছিবাঘভালুক কিছুই দেখিনি। শেয়াল-টেয়াল অবশ্য দেখেছি। সুরেশ্বর শেষ কথায় হাসল।
ভরতু লণ্ঠন এনে দিল। বাইরে সব সময়ে দু-একটি চেয়ার, ছোট চৌকি মতন টুল পড়ে থাকে। টুল টেনে লণ্ঠন রেখে আবার চলে গেল ভরতু।
সুরেশ্বর নরম গলায় বলল, ছেলেবেলায় ছাতে উঠতে আমার খুব ভাল লাগত। দেশের বাড়ি– ছাতটা ছিল মস্ত, ঘুলঘুলি দেওয়া, আলসে উঁচু। আলসেটা আমার প্রায় মাথায় মাথায়। একদিকে ছিল নদীর চরা, সামনে আমবাগান আর দূরে রথতলার মাঠ। ছাতে উঠলে মনে হত, কে যেন আমায় এতক্ষণ আটকে রেখেছিল, আমি ছাড়া পেয়ে গেছি। পায়ে ভর দিয়ে নদী আর রথতলার মাঠ দেখতাম, পা ব্যথা করলে বসে বসে ঘুলঘুলি দিয়ে তাকিয়ে থাকতাম। একদিন আমি আলসেতে অল্প একটু উঠে বুক ঝুঁকিয়ে কিছু দেখছিলাম, কে যেন দেখে ফেলেছিল। সেই যে ধরা পড়ে গেলাম, মা আর ছাতে উঠতে দিত না একলা।
ভয়ে। হৈমন্তী বলল; এমনভাবে বলল যাতে মনে হল সুরেশ্বরের মার ভয় অকারণ ছিল না।
ছাতে আমি ছুটোছুটি করতাম না, আলসের ওপর ওঠাও আমার সাধ্য ছিল না। তবু মার কী ভয়! সুরেশ্বর একটু হাসল। দু মুহূর্ত চুপ করে থেকে বলল, আমার এক মাসি ছিল–বিনুমাসি, মার দেখাশোনা করত, বিনুমাসি আমায় কপালকুণ্ডলার গল্প বলেছিল; আমার কেমন একটা ভয় ছিল, ওই নদীর চরা দিয়ে কাঁপালিকটা রোজ আসা-যাওয়া করে। একবার এক সাধুবাবাকে নদীতে দেখে ভয়টা আরও বেড়ে গিয়েছিল।
সুরেশ্বরের ছেলেবেলার কথা হৈমন্তী যেটুকু শুনেছে তাতে মানুষটির ওপর তার কেমন সহানুভূতি ছিল; ওর মা ছিলেন অসুস্থ, মাথা পাগল; বাবা ছিলেন যেমন রাশভারী তেমনি দুর্জন। অর্থ ছিল, অত্যাচারও ছিল। স্ত্রীর সঙ্গে বড় একটা সম্পর্ক রাখেননি। সুরেশ্বরের মা বেঁচে থাকার সময়েই তিনি অন্য এক স্ত্রীলোককে স্ত্রী হিসেবে রেখেছিলেন। এই উপপত্নীটি থাকতেন কলকাতায়। কাজেকর্মে সুরেশ্বরের বাবাকে প্রায়ই কলকাতায় এসে থাকতে হত। বাসা ছিল, ব্যবস্থাও ছিল। মহিলার একটি পুত্রসন্তান হয়। সুরেশ্বরের বাবার মৃত্যুর পর সম্পত্তি দাবি করে মামলার ভয় দেখিয়েছিল ওরা। সুরেশ্বর মামলা চালায়নি, দাবি মিটিয়ে দিয়েছিল।
হৈমন্তী এ সমস্তই মার কাছে শুনেছে। মার ধারণা, সুরেশ্বর আগাগোড়া বোকামি করেছে। সম্পত্তির অংশ দেবার কোনও দরকার তার ছিল না। আইন সুরেশ্বরের পক্ষে ছিল।
হৈমন্তী অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিল, সতর্ক হল।
সুরেশ্বর কথা বলল। আমার মার আর-একটা অদ্ভুত ভয় কী ছিল জানো? মা কোথাও দড়ি টাঙানো দেখতে পারত না। দড়ি দেখলেই মার কী যেন হত, চেঁচামেচি হইচই করে সে এক কাণ্ড করত। মা ভাবত, হাতের সামনে দড়ি থাকলেই মা বুঝি কিছু করে বসবে। …অথচ মা সুরেশ্বর বলতে গিয়েও থেমে গেল। তারপর কথা ঘুরিয়ে নিয়ে বলল, তুমি মাসিমাকে লিখে দিয়ো এখানে সত্যিই বাঘভালুকের ভয় নেই।
কথার পিঠে কথা বলতে হৈমন্তীর ভাল লাগে না। এখানে শেয়াল আছে না বুনো কুকুর আছে তা নিয়ে মাথা ঘামানোর ইচ্ছেও এখন তার নেই। চিঠিতে মা একটা কথা লিখেছে–সেটা কি জানিয়ে দেবে? জানানো নয়; মা যা জানতে চেয়েছে ঘুরিয়ে হৈমন্তীও যেন তা জেনে নিতে চায়। অথচ সুরেশ্বরের কাছে কথাটা বলা যায় না।