হৈমন্তী নিজের ঘরে এল। মালিনীকে দেখলে কিছু বোঝা যায় না, কিন্তু তার সঙ্গে মিশলে বোঝা যায়, এখানে সে পুরোপুরি মনোসুখে নেই, কোথায় যেন তার একটা অভাব রয়েছে। এই অভাব, ওপর ওপর থেকে দেখলে মনে হবে, তুচ্ছ কটা বাস্তব জিনিস, যা সহজলভ্য, অথচ সে পায় না তার জন্যে; ভেতরে চোখ ফেললে মনে হবে মালিনীর অভাব অন্য কোথাও। সুরেশ্বরের অন্ধ আশ্রমে সে কত, রকমের কাজ করছে, এই কাজে তার মুখ ভার হয় না, বরং বেশির ভাগ সময়েই হাসি হাসি ভাব, অথচ সন্দেহ হয়, মনে মনে মালিনী কোনও দুঃখ নিয়ে আছে। কী দুঃখ?
আর-একদিন মালিনী জিজ্ঞেস করেছিল: আপনি এখানে কেন এলেন হেমদি?
হৈমন্তী এ-ধরনের প্রশ্নে অস্বস্তি বোধ করেছিল, সরাসরি কোনও জবাব দেয়নি, দায়সারা একটা জবাব দিয়েছিল। কিন্তু সে অন্যমনস্ক হয়ে গিয়েছিল।
মালিনী ঘরে এল। তাড়াতাড়ি করে কাপড় বদলে নিয়েছে, চুল বেঁধেছে এলো করে, হাতে চায়ের কাপ। বলল, আমি চলি হেমদি, সন্ধের বাসে ফিরব। …আপনার জন্যে ছাঁচি পান নিয়ে আসব, আমাদের ওখানে একজন যা পান করে দেখবেন… মালিনী চলে গেল।
সামান্য পরেই হৈমন্তী জানলা দিয়ে দেখল, মালিনী যেন ছুটতে ছুটতে যাচ্ছে, পরনে মিলের সাদা শাড়ি, গায়ে সাদা জামা, পায়ে পুরনো চটি, একহাতে একটা ছাতা। খোঁপার গোড়ায় লাল ফিতে বাঁধা।
দেখতে দেখতে মালিনী অনেকটা চলে গেল। হৈমন্তীর মন কেমন ভার হয়ে এল হঠাৎ।
বিকেল পড়ে গিয়েছিল। হৈমন্তী অন্য দিনের মতন আশ্রমের বাইরে এসে জামতলার পাশ দিয়ে কাঁচা রাস্তা ধরে বেড়াচ্ছিল। আকাশ পরিষ্কার, হালকা পাতলা পেঁজা তুলোর মতন ভেঁড়া এক-আধ টুকরো মেঘ ভেসে যাচ্ছে, রোদ ফুরিয়ে গেছে, দূরে টিলার গায়ে গায়ে শেষ একটু আলো, ঠাণ্ডা বাতাস বইছিল, পুবের বাতাস, পাখির ঝাঁক গাছ ডিঙিয়ে চলে যাচ্ছে।
কাঁচা রাস্তা ধরে খানিকটা পথ হেঁটে আসার পর হৈমন্তী একটু দাঁড়াল। সাইকেলে করে কে যেন আসছে। দূর থেকে চেনা গেল না। কাছাকাছি এলে হৈমন্তী চিনতে পারল, শিবনন্দনজি। শিবনন্দনজি সুরেশ্বরের পরিচিত, আশ্রমে অন্ধদের হাতের কাজকর্ম শিখিয়েছেন–বেতের কাজ, গামছা বোনা, বাঁশের টুকটাক জিনিস, খেলনা এই সব। জিনিসগুলো বেচা কেনার ব্যবস্থা তিনিই করেন। যেতে যেতে শিবনন্দনজি সাইকেল থেকে না নেমেই সম্ভাষণ জানিয়ে বললেন, এদিকে কোথায় যাচ্ছে হৈমন্তী, সন্ধে যে হয়ে এল।
কথাটা শুনলেও অন্যমনস্কভাবে হাঁটছিল। আরও খানিকটা পথ এগিয়ে এসে হৈমন্তী হঠাৎ দাঁড়াল। আলো এত ম্লান হয়ে এসেছে যে দূরের জিনিস আর দেখা যায় না, ঝাপসা অন্ধকারে সব একাকার হয়ে আছে। সন্ধ্যার কালিমা অগোচরে শূন্যের রং ধূসর ও আঁধার করে তুলছে।
হৈমন্তী আকাশের দিকে তাকাল, পরে চোখ নামিয়ে সামনের দিকে। দূরের আর কিছুই তার দৃষ্টিগোচর হল না।
আর সহসা, মালিনীর সেই প্রশ্ন, এখন এই নির্জনে, নিঃসঙ্গ অবস্থায় তার মনে পড়ল: আপনি এখানে কেন এসেছেন, হেমদি?
হৈমন্তী কিছুক্ষণ নিঃসাড় হয়ে দাঁড়িয়ে থাকল। সে কেন এসেছে? কেন?
যেমন দুরের কিছু আর দেখা যাচ্ছিল না, হৈমন্তীও যেন সেই রকম কিছু দেখবার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়ে কিছু ভাবতে পারছিল না। সে কেন এসেছে? কার কাছে? কোন প্রত্যাশায়?
ভীত মানুষের মতন হৈমন্তী হঠাৎ ফিরতে লাগল, তাড়াতাড়ি।
.
০৪.
সুরেশ্বর বাগানের কয়েকটা গাছপালা পরিষ্কার করে মাটিমাখা হাতে দাঁড়িয়েছিল, হৈমন্তী এল।
এসো– সুরেশ্বর সহজ সরল অভ্যর্থনা করল।
বাগানই দেখছিল সুরেশ্বর, দেখতে দেখতে আঙুল দিয়ে একটা জায়গা দেখাল, ভাবছি ওখানটায় মাটি একটু খুঁড়িয়ে নিয়ে কিছু মরশুমি ফুলের বীজ ছড়িয়ে দেব। সামনে শীত আসছে–খুব ফুল ফুটবে।
হৈমন্তী বাগানের দিকে তাকাল। এ কোনও সাজানো বাগান নয়, এখানে ওখানে গাছপালা বেড়েছে। সুরেশ্বর যে বাগান নিয়ে মাথা ঘামায় তেমন, তা বোঝা যায় না। হৈমন্তী চোখ তুলে সুরেশ্বরকে কপলক দেখল, অন্য দিকে দৃষ্টি ফেরাল: মরশুমি ফুলের বীজ ছড়ানোর কথাটা হৈমন্তীর কানে ছেলেমানুষের মতন শুনিয়েছিল।
কথা বলতে হয় বলেই যেন হৈমন্তী বলল, শীতের এখন অনেক দেরি।
সুরেশ্বর আস্তে মাথা নাড়ল, হাসি মুখে বলল, না হেম, এ তোমাদের কলকাতা নয়। এখানে দেখতে দেখতে শীত এসে যাবে। পুজোর পরপরই।
হৈমন্তী কিছু বলল না।
সুরেশ্বর দুহাত রগড়ে রগড়ে শুকনো মাটি হাত ঝেড়ে ফেলে দিতে দিতে বলল, এখানে বর্ষাটা যেমন খারাপ লাগে, শীতটা আবার তেমনি সুন্দর…। আছো তো, দেখতেই পাবে। …চলো, বারান্দায় গিয়ে বসি।
কয়েক পা এগিয়ে সিঁড়ি, ছোট ছোট পাঁচ ছ ধাপ। সিঁড়ি উঠে সুরেশ্বর বলল, বসো, হাতটা ধুয়ে আসি।
হৈমন্তী বসল না, দাঁড়িয়ে থাকল।
বর্ষ যে ফুরিয়ে গেছে বেশ বোঝা যায়। আজ চার পাঁচদিন বৃষ্টি নেই। শরতের বৃষ্টির মতন এল-গেল এক আধ পশলা যা হয়েছে তা কিছুই না। আকাশের রং বদলে গেছে; ধোয়ামোছা হালকা নীল। রোদ খুব পরিষ্কার আর ঝকঝকে। বিকেলও যেন দেখতে দেখতে ফুরিয়ে যাচ্ছে।
হৈমন্তী চোখ তুলল। আকাশের তলায় যেটুকু ধূসর আলো তা ক্রমশই কালোয় মিশিয়ে যাচ্ছিল, মিশে চোখের পাতার মতন আকাশের পট ঢেকে দিচ্ছিল। তারা ফুটছে। স্নিগ্ধ এলোমেলো বাতাস পাচ্ছিল হৈমন্তী।