সবই অভ্যেস। আর কটা দিন কেটে যাক, তখন হৈমন্তী এই নির্জনতা, নিস্তব্ধতা, হ্যারিকেনের মিটমিটে আলো, বাইরের নিবিড় অন্ধকারে অস্বস্তি অনুভব করবে না, ভয় পাবে না।
হৈমন্তী মাঠে নেমে এল। নরম ঘাসে তার পায়ের চটি ডুবে আছে। বড় বড় ঘাসের ডগা গোড়ালি পর্যন্ত; হাঁটার সময় মনে হয় যেন অল্প জলে পা দিয়ে হাঁটছে, এত নরম আর কোমল।
সামান্য এগিয়ে হৈমন্তী দাঁড়াল। মালিনী আসছে।
মালিনী তাড়াতাড়ি হাঁটে, দেখলে মনে হয় ছুটে ছুটে হাঁটছে। হাঁটার সময় ওর সমস্ত শরীর দোলে। অল্প দুর থেকে মালিনীকে বৈশ দেখাচ্ছিল। রং কালো হলেও মালিনীর গড়নটি নরম, মাথায় মাঝারি, চোখমুখ টলটলে। মালিনী হাসতে হাসতে আসছিল। তার সাদা ধবধবে দাঁত, মাথা ভর্তি এলো চুল, পরনের সাদা শাড়ি রোদের আভায় যেন আরও দেখার মতো হয়ে উঠেছিল। বুকের কাছে কাপড় জামা জড়ো করে এমনভাবে ছুটে ছুটে আসছে যে মনে হচ্ছে যেন কিছু চুরি করে পালাচ্ছে। হৈমন্তীর হাসি পেল।
কাছে এসে মালিনী বলল, যাবেন?
হৈমন্তী চোখে চোখে চেয়ে থাকল। কোথায়?
আমাদের বাড়ি।
মালিনীর বাড়ি রেলস্টেশনের কাছে। বাড়িতে মা আছে, ছোট ভাই আছে, বোন আছে।
তুমি বাড়ি যাচ্ছ?
মালিনী মাথা নাড়ল, মুখভরা হাসি। কপালে গালে ঘাম ফুটে আছে।
যাবে কী করে?
বাস।
বাস তো চলে গেছে। হৈমন্তী অবাক হয়ে বলল।
যে বাস গেল সেটা কি স্টেশনের? দূর…ওটা শহরে যাবার। এত করে শিখিয়েও মালিনী যেন এই নতুন মানুষটিকে কিছু মনে রাখতে পারল না। কাঁচা রাস্তাটুকু হেঁটে গেলে মোড়ের মাথা থেকে স্টেশন যাবার বাস যে এখন পাওয়া যাবে–হেমদিদি তাও ভুলে গেছে। কখন কী বাস পাওয়া যায় তার একটু দ্রুত বিবরণ আবার মনে করিয়ে দিয়ে মালিনী বলল, তিনটের বাস শহরে যায়, চারটের বাস যায় স্টেশন, লাটঠার মোড়ে গিয়ে বাস ধরতে হবে। যাবেন?
হৈমন্তী হ্যাঁ-না কিছু বলল না। সুরেশ্বরকে বলতে হবে, মাইল খানেকের ওপর হাঁটা, অত সময় কই! তারপর ফেরার বাস। ফিরবে কখন?
তুমি ফিরবেনা আজ? হৈমন্তী শুধোল। মালিনী না থাকলে তাকে একলা থাকতে হবে। এক ঘরে না থাকলেও তারা পাশাপাশি থাকে, রাত্রে এ একটা বড় স্বস্তি হৈমন্তীর। মালিনী না ফিরলে হৈমন্তী থাকবে কী করে?
ফিরব।
হৈমন্তীর দুর্ভাবনা গেল। বলল, আজ আর সময় কই! পরে একদিন যাব।
মালিনী বলল, আজই চলুন। চারটেয় বাস আসে না, বলে চার, আসতে আসতে সাড়ে চার। ঢের সময় আছে।
হৈমন্তীর ইচ্ছে হচ্ছিল যায়, অথচ ছুটোছুটি করে যেতে হবে বলে যেন ভরসা পাচ্ছিল না। তার কিছু কেনাকাটা করার দরকারও ছিল। মাথার তেলের শিশিটা হাত ফসকে পড়ে ভেঙেছে, যেটুকু তেল বেঁচে ছিল তাতে এ কদিন কোনও রকমে হয়েছে। গায়ে মাখার সাবান ফুরিয়ে এল। দরজার পরদার জন্যে খানিকটা কাপড় কিনতে হবে। এই ধরনের সব টুকটাক। সুরেশ্বরকে বললে আনিয়ে দেবে, কিন্তু হৈমন্তী বলতে চায় না। সঙ্কোচ অনুভব করে। মালিনী তাকে চা তৈরি করে খাওয়ায়, সেই চা হৈমন্তীর ভাল লাগে না। খানিকটা ভাল চা আনতে হবে। কিছু বিস্কুট।
সুরেশ্বরকে হৈমন্তীর সুখ-সুবিধের কথা বলা যায় না। বললে হয়তো সব হবে, কিন্তু কী ভাববে সুরেশ্বর! তার জন্যে বাড়তি খরচে সুরেশ্বর আপত্তি করবে না, তবে মনে মনে হাসবে। তেল, সাবান, চায়ের মতন তুচ্ছ কটা জিনিসের জন্যে এত খুঁতখুঁতুনি!
হৈমন্তী মালিনীর দিকে তাকাল। মালিনীকে দিয়েও এসব আনানো যায়। কিন্তু মালিনীর কি অত সময় হবে? সে কি পছন্দমতন সব আনতে পারবে?
মালিনীর তাড়া ছিল। চঞ্চল হয়ে উঠে মালিনী বলল, আপনার যে কত ভাবনা! চলুন। দেরি হয়ে যাচ্ছে।
যাবার মন হৈমন্তীর ছিল। আসবার দিন স্টেশনের কিছুই প্রায় সে ভাল করে দেখেনি; বাসে এসে বসেছিল, সটান চলে এসেছে; ওরই মধ্যে দেখেছে, দোকান-পশার আছে স্টেশনে, লোকজন, আলো মোটামুটি যা হৈমন্তীর দেখা অভ্যেস, যার মধ্যে সে এতকাল থেকেছে। এখানে এসে পর্যন্ত সে এসব আর দেখেনি! দেহাতি রোগীদের মুখ ছাড়া আর-একটা নতুন মুখ নয়।
মালিনী হাঁটতে শুরু করেছিল, হৈমন্তীও পাশে পাশে চলতে লাগল। বলল, আজ আর যাব না। কাল পরশু যাব। আমার কিছু কেনাকাটা করতে হবে।
মালিনী হেসে বলল, একলা?
তুমিও যাবে।
না ।
কেন?
রোজ রোজ বাড়ি গেলে দাদা রাগ করবে। মালিনী সুরেশ্বরকে দাদা বলে।
হৈমন্তী মালিনীকে দেখল। মালিনীর মুখে কোনও রকম ক্ষোভ নেই।
আজ দাদা টাকা দিয়েছে। মাকে দিয়ে আসব। …আমার ভাইটা, বলেছি না আপনাকে, বিজলি-অফিসে চাকরি করে, ছোট চাকরি, টাকা না পেলে মার কষ্ট হয়।
মালিনী এখানে টাকা পায় হৈমন্তী জানত না। মাইনে হিসেবে পায়, না সাহায্য? হৈমন্তী কৌতূহল বোধ করলেও কিছু জিজ্ঞেস করল না।
ঘরের কাছে এসে মালিনী বলল, এর পর যখন টাকা পাব, আপনাকে সঙ্গে করে নিয়ে যাব। আমায় একটা শাড়ি কিনে দেবেন। মিলের শাড়ি না, ভাল শাড়ি।
হৈমন্তী কথা বলল না, মাথা হেলিয়ে সায় দিল।
মালিনীর কথায় কোনও কোনও সময় সে অন্যমনস্ক হয়ে যায়। মালিনী ছেলেমানুষ নয়, বোধবুদ্ধিহীনও নয়, কিন্তু খুব সরল আর সাধাসিধে। বছর বাইশ বয়স হয়েছে, লিখতে পড়তেও একেবারে না জানে এমন নয়, তবু কখনও কখনও অবোধের মতন কথা বলে।
শাড়ি কেনার কথাটা এমন কিছু নয়, কিন্তু ওর কথার সুরে ছেলেমানুষের মতন কোথায় যেন একটু ক্ষোভ ছিল। এর আগে একদিন মালিনী বলেছিল: আপনি কত লোককে চিঠি লেখেন হেমদি, আমায় একটা খাম দেবেন–আমার একজনকে চিঠি লিখব।