হৈমন্তী বিছানা থেকে নামল। জানলায় দাঁড়ালে দুরে জামতলা দেখা যায়। জামতলা এখন নির্জন, কেউ নেই। দুপুরে ওখানে একে একে লোক জমে, পাঁচ সাত দশ–কিছু ঠিক নেই। গাঁ-গ্রাম থেকে লোক আসে; এখানে যারা চোখ দেখাতে আসে তারাও বাস-আসার সময় সময় জামতলায় ফিরে গিয়ে গাড়ির অপেক্ষা করে। বাসটা চলে গেলে সব ফাঁকা–জামতলা নির্জন।
আবার বাস আসবে একবার; সন্ধে নাগাদ। আসবে আর যাবে। ওই বাসেই হৈমন্তীরা এসেছিল। অবশ্য শেষ পর্যন্ত আর আসা হয়ে ওঠেনি, বাস খারাপ হয়ে রাস্তায় দাঁড়িয়ে গিয়েছিল, সেই ভদ্রলোক, অবনীবাবু, জিপে করে তাদের পৌঁছে দেন। ভদ্রলোকের কথাবার্তা কেমন যেন!
পাশের দিকের জানলা থেকে সরে হৈমন্তী বিছানার পায়ের দিকের জানলার কাছে এসে দাঁড়াল। জানলার আধখানা ঢেকে, নীচের দিকে, নতুন পরদা দিয়েছে; কচিকলাপাতা রঙের পরদা। হাতের কাছে কিছু ছিল না, আধ-পুরনো শাড়ি থেকে পরদা করা। বোঝা যায় না অবশ্য। এখানে কোথাও পরদা নেই, সব ফাঁকা, খোলামেলা। হাসপাতালের ঘরেই যা পরদা দেখা যায়। হৈমন্তী কেমন অস্বস্তি বোধ করছিল, কাছাকাছি কেউ কোথাও থাক না থাক–তবু ওইটুকু আড়াল না থাকলে তার স্বস্তি হচ্ছিল না।
জানলার কাছে দাঁড়িয়ে অলস চোখে হৈমন্তী সামনে তাকিয়ে থাকল। বর্ষার জলে মাঠের ঘাস বড় বড়, সবুজ হয়ে আছে। মোলায়েম জাজিমের মতন আশে-পাশে বিছানো। বিকেলের পরিষ্কার রোদে খুব ফিকে হলদের মতন একটা রং ধরেছে মাঠে। এখানে ওখানে গাছপালা, মস্ত একটা শিরীষ, হাসপাতাল-ঘরের কাছে একজোড়া অর্জুন গাছ। এখান থেকে হাসপাতাল-ঘরের অর্ধেকটা দেখা যায়, বাকিটা গাছের আড়ালে।
অন্যমনস্কভাবে হৈমন্তী আঙুল দিয়ে চুল ছাড়িয়ে পিঠময় ছড়াতে লাগল। চুল প্রায় শুকিয়ে এসেছে। শব্দ করে আবার একটু হাই তুলল। হাসপাতাল-ঘরের সামনে দিয়ে পাতলা মতন ছায়া ভেসে গেল, টুকরো মেঘ ভেসে যাচ্ছে, নিচু দিয়ে। বর্ষা বোধহয় ফুরিয়ে এল।
চোখ মুখ ধোবার জন্যে হৈমন্তী ঘর ছেড়ে বাইরে এল। তার ঘরের গায়ে গায়ে কাঁচা বারান্দা, পাশেই হলঘর। ওর ঘরের গা লাগিয়ে মালিনীর ঘর, মালিনীর ঘরের দরজা জানলা হাট করে খোলা, মালিনী পশ্চিমের মাঠে শুকনো কাপড় জামা তুলছে, তুলে বুকের কাছে জড়ো করছে।
কলঘর থেকে ফিরে হৈমন্তী ভিজে চোখ মুখে বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকল। এখান থেকে গোটা এলাকাটাই মোটামুটি দেখা যায়। জায়গা বড় কম নয়–হৈমন্তী জমির হিসেব বোঝে না, সুরেশ্বরের কাছে শুনেছে, প্রায় বিঘে পাঁচেক। সমস্ত জমি এখনও বেড়া দেওয়া হয়নি, কিছু হয়েছে, কিছুটা ফেলে রাখা হয়েছে ভবিষ্যতের জন্যে। শাল কাঠের খুঁটি আর তার দিয়ে বেড়া, কোথাও কোথাও বুনো কাঁটালতা ঘন হয়ে উঠেছে বেড়ার গায়ে। পুব পশ্চিম দক্ষিণ তিন দিকে ঘর উঠেছে। একে ঠিক পাকা বাড়ি বলা যায় না, আবার কাঁচা বাড়িও নয়। ইটের গাঁথুনি করা দেওয়াল, মাটির বাড়ি মাত্র একটি, মাথায় টালি বা খাপরা। হাসপাতাল বাড়িটার মাথায় শুধু অ্যাসবেস্টাস। সব সুষ্ঠু ছোট বড় খান পাঁচেক দালান, লম্বা লম্বা। জামরুল বা কাঁঠাল কাঠের দরজা জানলা।
পুবের দিকে সুরেশ্বরের ঘর। মাটির বাড়ি, মাথায় খাপরা, সামনে লতাগাছের জাফরি। এক সময়, সুরেশ্বর যখন প্রথম এখানে এসে আশ্রয়ের জন্যে ঘর বাঁধে তখন কাঠকুটো কঞ্চি দিয়ে বেড়া দিয়েছিল সামনে, লতাপাতা লাগিয়েছিল। দিনে দিনে লতাপাতা বেড়ে সামনেটা জাফরির মতন আড়াল পড়েছে, বেড়া ভেঙে গেছে কবে। ওখানে কিছু ফুলের গাছ-জবা, করবী, বেল, দোপাটি। জুই গাছের ডালপালা বাড়ির মাথায় গিয়ে উঠেছে। সুরেশ্বরের বাড়ির একপাশে সিমেন্ট বাঁধানো ছোট একটু বেদি।
মফস্বলের স্কুল বাড়ির মতন লম্বা লম্বা কয়েকটা দালান বেশ খানিকটা তফাত তফাত পুব পশ্চিম দক্ষিণে ছড়ানো। সামান্য উঁচু করে ভিত, ইটের গাঁথনি, মাথায় খাপরা কিংবা টালি, বড় বড় জানলা আর দরজা। কোথাও কোনও রকম বাহুল্য নেই, নিতান্ত যেটুকু প্রয়োজন তার অতিরিক্ত কিছু না। দালানগুলোর সামনে কোথাও করবী ঝোপ, কোথাও কলাফুলের গাছ, টিপফুল, কাঠচাঁপা গাছ, রঙ্গন ফুল। আর অজস্র সবুজ ঘাস।
পশ্চিমের দালানটায় যারা থাকে তারা কজনই পুরোপুরি অন্ধ। কাছাকাছি একটা ঘরে ওরা হাতের কাজ করে। পেছন দিকে বাগান। পুব-দক্ষিণ ঘেঁষে যে দালানটা সেটা তেমন বড় নয়, ছোটই; ওখানে পাঁচ-সাতজন রোগী আছে, বাচ্চাকাচ্চাই বেশি। তারই পাশে মেয়ে রোগী জন দুই তিন।
দক্ষিণের ঘোট দালানটায় হৈমন্তী আর মালিনী থাকে। দেহাতি কটা চাকরবাকর থাকে অল্প তফাতে।
জল বলতে দুটো ইঁদারা। খুব কাছেই নদীর একটি শীর্ণ স্রোতোধারা আছে অনেকেই সেখানে যায়; এখন বর্ষার শেষে জলভরা সেই শীর্ণ ধারাটিকে ছোটখাটো নদী বলেই মনে হয়।
এখানে এসে হৈমন্তীর ভালই লাগছিল। সকালটা কাজেকর্মে কেটে যায়, দুপুর থেকে নিরিবিলি, আলস্য আর বিশ্রামে কাটে, বিকেলটাও মন্দ না কখনও ঘুরে বেড়ায়, কখনও সুরেশ্বরের সঙ্গে কথাবার্তা বলে, গল্প করে; কখনও তার সঙ্গী হয় মালিনী। সন্ধে হয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গে সারাদিনের ভাললাগাটুকু ফিকে হয়ে আসতে থাকে। তখন আর মন বসাতে পারে না এখানে। বড় নির্জন, ফাঁকা, শূন্য মনে হয় সব। রাত যত বাড়ে ততই কেমন অস্বস্তি বোধ করে, উদ্বেগ জমতে থাকে, শেষে ভয় ভয় করে।