প্রথমাবধিই তার সংশয় ছিল। নানা রকমের দ্বিধাও ছিল। অনেক দিন পর্যন্ত অনিশ্চিত বোধ করেছে। নিজের কর্মের সাফল্য সম্পর্কে এই সংশয়বোধ তাকে চিন্তিত করলেও হতাশ করতে পারত না।
নিজের সঙ্গতি ও সামর্থ্য মতন সুরেশ্বর তার অন্ধ আশ্রমের ভিত পাতল। অন্ধ আশ্রম নামটা সে দেয়নি; এটা লোকমুখে রচিত হয়েছে। দেহাতের মানুষ এখনও বলে, দাবাইখানা।
গুরুডিয়ায় এসে প্রথমে নিজের মাথা গোঁজার মতন এক চালা করে নিয়েছিল সুরেশ্বর, আর ছোট মতন এক কুঁড়েঘর করেছিল পাশেই, সেটাই ছিল চোখের হাসপাতাল। শহর থেকে সপ্তাহে একদিন বাসে চেপে আসতেন এক মাদ্রাজি ক্রিশ্চান, প্রায় বৃদ্ধ মামেনসাহেব। মিশনারি হাসপাতালে চোখের ডাক্তারি করেছেন দীর্ঘকাল। এখন অবসর নিয়েছেন। তবু যথাসাধ্য সাহায্য করেন আতুর অনাথকে। হাটের দিন দেহাত থেকে আসা-যাওয়ার পথে গ্রাম্য মানুষগুলি সুরেশ্বরের চোখের হাসপাতালে চোখ দেখিয়ে নিয়ে যেত। সুরেশ্বরকে সাইকেল চেপে দেহাতের গ্রামে গ্রামে এক সময় ঘুরে বেড়িয়ে তার চোখের হাসপাতালের কথা বলতে হয়েছে। এ অঞ্চলে চোখের ব্যাধি কম নয়। বাচ্চাকাচ্চা থেকে শুরু করে জোয়ান মজুররাও নানা রকম চক্ষুরোগে ভোগে।
আশ্রমের গোড়াপত্তন হয়েছিল এইভাবে, অতি দীন চেহারা নিয়ে। ক্রমে ক্রমে সে চেহারা বদলে আসছে। এখনও এমন কিছু হয়নি যা দেখে বিমূঢ় বা হতবুদ্ধি হতে হয়; নিতান্ত সাধারণ সাদামাটা একটা আকার নিতে পেরেছে। তবু, এখানে বনে জঙ্গলে দেহাতে–যেখানে কোনও কিছুই ঘটে না, প্রাকৃতিক নিয়মে শুধু গাছপালা বাড়ে আর জৈবিক নিয়মে মানুষের জন্মমৃত্যু ঘটে–সেখানে সাধারণ যা ঘটল, যতটুকু ঘটল তাতেই অনেকে বিস্মিত হয়, হয়তো মুগ্ধও হয়। সুরেশ্বরের অন্ধ আশ্রম অনেকটা সেই রকম বিস্ময়কর ঘটনা।
অন্ধ আশ্রমের সব কথা হৈমন্তীর জানা ছিল না, কিছু কিছু শুনেছিল, চিঠিপত্রেও জেনেছিল। গুরুডিয়ায় এসে দেখছিল সব।
কেমন দেখছ? সুরেশ্বর পরের দিনই জিজ্ঞেস করেছিল হৈমন্তীকে।
বেশ সুন্দর। হৈমন্তী তখনও তেমন করে কিছু দেখেনি।
জায়গাটা সুন্দরই। …আমাদের ব্যবস্থা কেমন দেখছ?
আমি আর কতটুকু বুঝি। ভালই লাগছে।
তোমার হাসপাতাল?
সবই তো আছে। অসুবিধে খুব একটা হবে না।
প্রথম যখন হয়েছিল, তখন একটা কুঁড়েঘর আর টিনের চেয়ার। হাটবারের দিন মামেনসাহেব আসতেন। একটা সুটকেস হাতে, যন্ত্রপাতি বয়ে আনতেন।
এখন অনেক হয়েছে।
সাহেব নিজেই অর্ধেক জিনিস দিয়েছেন, বাকি কিনতে হয়েছে। …গত বছরে সাহেব মারা গেছেন। এখন যিনি আসেন, তাঁর নানা অসুবিধে। সাহেব বেঁচে থাকতে তাঁর পছন্দমতনই হাসপাতালটা করিয়েছিলেন।
কাজের মানুষ।
নিষ্ঠাবান ব্যক্তি। দয়া ধর্ম প্রেম–তিনগুণে তিনি যথার্থ ক্রিশ্চান ছিলেন: সুরেশ্বর সশ্রদ্ধায় বলল। তারপর আবার বলল, কুড়ি বছর শুধু এদিকের, সমস্ত মিশন হাসপাতালে দীনদরিদ্রের চোখ দেখে বেড়িয়েছেন। বলতেন: যিশু অন্ধকে দৃষ্টিশক্তি ফিরিয়ে দিয়েছিলেন, আমরা পাপীজন–মানুষকে দৃষ্টিহীন করি।
হৈমন্তী নীরব থাকল।
সুরেশ্বর পরে জিজ্ঞেস করেছিল, কেমন লাগছে তোমার?
ভাল।
থাকতে পারবে?
হৈমন্তী চোখ তুলে তাকাল, দেখল সুরেশ্বরকে, অল্প করে মাথা নোয়াল পারব।
তারপর থেকে আজ কদিন হৈমন্তী নতুন আবহাওয়া এবং পরিবেশের সঙ্গে নিজেকে মানিয়ে নেবার চেষ্টা করছে।
.
দু চোখ ভরে ঘুম জড়িয়ে আসছিল। বাসের ঘন ঘন হর্নে চোখের পাতা খুলল হৈমন্তী, আবার সঙ্গে সঙ্গে চোখ বুজল। তার ঘোরে কয়েক দণ্ড কাটল, তারপর আধবোজা চোখে জানলার দিকে তাকাল, খানিকটা দূরে জামতলায় বাস এসে থেমেছে, লোজন তুলে নিচ্ছে, এখুনি আবার হর্ন দিয়ে চলে যাবে। বিছানায় শুয়ে হৈমন্তী কিছুই দেখতে পাচ্ছিল না, কিন্তু সবই বুঝতে পারছিল। আজ আট-দশ দিনে মোটামুটি এখানকার সবই তার জানা হয়ে গেছে। এই বাসটা দুপুরের, এখন প্রায় তিনটে বাজে, কিংবা বেজে গিয়েছে।
শেষ কয়েকবার হর্ন দিয়ে বাসটা চলে গেল। হৈমন্তী আলস্যভরে হাই তুলল, চোখের দৃষ্টি এখনও পরিষ্কার নয়, তন্দ্রাজড়িত সামান্য ছলছলে ভাব রয়েছে।
এইভাবে আরও সামান্য সময় শুয়ে থেকে চোখ মুছে হৈমন্তী বিছানায় উঠে বসল। বড় করে হাই তুলল। দুপুরে সে ঘুমোতে চায় না, তবু এখানে–এত নিরিবিলি এবং নির্জনতার মধ্যে শুয়ে থাকতে থাকতে, কাগজপত্র বই পড়তে পড়তে কখন যেন দু চোখ জড়িয়ে আসে। ঘুমিয়ে পড়লে রাত্রে আর ঘুম আসতে চায় না। এখানে রাত্রে জেগে থাকা কেমন যেন! হৈমন্তীর ভয় করে। মনে হয়, বিশ্বসংসারে কেউ কোথাও নেই, জনপ্রাণী না, শুধু সে একা; চারপাশের অবর্ণনীয় স্তব্ধতা তার চেতনাকে এত নগণ্য, হেয় ও তাৎপর্যহীন করে তোলে যে হৈমন্তী কেমন এক আতঙ্ক অনুভব করে মৃতপ্রায় হয়ে থাকে।
এ-রকম দু দিন হয়েছিল। তারপর থেকে হৈমন্তী দুপুরে ঘুমোতে চায় না। এমনকী একটু বেশিক্ষণ তন্দ্রার ঘোরে শুয়ে থাকলেও বিকেল থেকে সে কেমন অস্বস্তি বোধ করে, রাত্রের কথা ভেবে তার উদ্বেগ হয়। হয়তো এসব কিছুই না, আর কদিন পরে সবই অভ্যাস হয়ে যাবে। একেবারে নতুন জায়গা, পুরনো অভ্যস্ত জীবনের সঙ্গে কোথাও কোনও মিল নেই, সাদৃশ্য নেই, এমন করে আগে সে আর কখনও থাকেনি–তাই নতুন নতুন এ রকম লাগে। পরে আর লাগবে না।