অথচ লোকটা ভদ্র, শিক্ষিত, বুদ্ধিমান। অবনী বুঝতেপারে না, কী করে তার প্রায় সমবয়সী একজন, আজকের দিনে এমন করে নিজেকে প্রবঞ্চনা করতে পারে এই জঙ্গল কি তার অন্ধ-আশ্রম খোলার জায়গা? যদি তোমার মহৎ উদ্দেশ্যই থেকে থাকে–কেন তুমি নিজে ভাল চোখের ডাক্তার হলে না? কেন শহরে-গঞ্জে লোকালয়ে চেম্বার খুলে বসলে না? কেন কোনও হাসপাতালের সঙ্গে থাকলে না?
তুমি ধর্মপ্রাণ, ঈশ্বর বিশ্বাসী। অবনীর তাতে কোনও আগ্রহ নেই। উৎসাহও নেই। বরং উপেক্ষা আছে। মানুষের যার যা পছন্দ তা বিশ্বাস করতে পারে, ভূত-প্রেত, পরজন্ম দীন-দয়াল অবতার কারুর কিছু বলার নেই। অবনী এসব গ্রাহ্য করে না। সে অন্য কিছু বিশ্বাস করে, বিজলীবাবুর আবার অন্য ধারণা।
কিন্তু, অবনী বুঝতে পারল না, সুরেশ্বর কী করে বাস্তবিকই গুরুডিয়ার জঙ্গলে অন্ধ আশ্রম গড়ে তুলতে পারল। কিছুনা হোক–হঠাৎ দেখলে অবাক হবার মতন খানিকটা নিশ্চয় করেছে। কেমন করে করল?
কেমন করেই বা হৈমন্তীর মতন একটি মেয়েকে সুরেশ্বর এখানে টেনে আনল? হৈমন্তীই বা কেন এল? সুরেশ্বর কি তাকে ভুলিয়ে এনেছে? ভাসিয়ে এনেছে? যেমন করে নিজে ভেসে এসেছে–তেমন করেই কী ভাসিয়ে এনেছে হৈমন্তীকে? নাকি সুরেশ্বরকে ভালবেসে এসেছে ও? ভা…ল…বা…সা…?
কী যে সম্পর্ক দুজনের কিছুই বোঝা যায় না। সুরেশ্বরকে রহস্যময় পুরুষ বলেই মনে হচ্ছিল অবনীর। তার আশ্রমে যুবতী সমাগমের পরিণতি কী হবে তাও বোঝা যাচ্ছিল না।
.
আরও খানিকটা বেলায় পোস্টঅফিসের ফোন মারফত অবনীর কাছে খবর এল, হীরালাল কাল রাত্রে মারা গেছে।
সুরেশ্বর শহর থেকে ফোন করেছিল।
.
০৩.
এক সময়ে জায়গাটার কোনও নামই ছিল না, গুরুডিয়া ছিল আরও একটু তফাতে। সুরেশ্বরের অন্ধ আশ্রম গড়ে ওঠার সময় গুরুডিয়া যেন পা বাড়িয়ে এইটুকুও চলে এল। তখন গুরুডিয়া বললে বোঝাত গ্রাম, এখন বোঝয় অন্ধ আশ্রম। তখন ঠিক এই অঞ্চলটায় কোনও লোকবসতি ছিল না, জঙ্গল আর মাঠ ছিল পড়ে; সারা শীত শালের জঙ্গলে কাঠ কাটতে আসত কাঠুরিয়া, কাঠ কাটার শব্দ আর বয়েল গাড়ির আসা-যাওয়াতে সকাল দুপুর সাড়া দিত। যুদ্ধের শেষাশেষি এদিককার বনজঙ্গল কিছু পরিষ্কার হয়, কাঁচা রাস্তাও খানিকটা হয়েছিল। সঠিক বিবরণ কেউ জানে না, তবে ব্যারাক হয়েছিল কিছু, কাঁটাতারের বেড়াও পড়েছিল। কেউ বলত গুর্খা সেপাইদের চাঁদমারি হয়েছিল, কেউ বলত কয়েদি মাঠ। সম্ভবত যুদ্ধের শেষাশেষি কিছু হবার উপক্রম হয়েছিল এখানে, যুদ্ধ থেমে যাওয়ায় সব বন্ধ হয়ে গেল। যেটুকু হয়েছিল ফেলে দিয়ে চলে গেল ওরা। তারপর দীর্ঘদিন ব্যারাকের কাঁচা বাড়িগুলো পড়েই থেকেছে, দেহাতিরা ক্রমে ক্রমে ইট কাঠ খসিয়ে নিয়ে গেছে কিছু, বাকিটা ঝড়ে জলে রোদে বৃষ্টিতে মাটিতে মিশেছে।
দেখেশুনে সুরেশ্বর এই জায়গাটাই পছন্দ করেছিল। কারণ তার সামর্থ্য ছিল পরিমিত। নিজের কিছু সঙ্গতি আর অন্যের অনুগ্রহের ওপর যেখানে নির্ভর সেখানে এর বেশি কিছু প্রত্যাশা করা যায় না। নামমাত্র মূল্যে অনেকটা জমি পেল এখানে সুরেশ্বর, কাঁচা রাস্তা পেল, মোেটামুটি আশপাশ পরিষ্কার আর সামান্য দূরে একটা গ্রাম পেল। ভাঙাচোরা ব্যারাকের কিছু অবশেষ, তাও বা মন্দ কী!
ভেবে দেখতে গেলে সুরেশ্বর জায়গাটা মোটামুটি ভালই পছন্দ করেছিল। এখানকার প্রাকৃতিক পরিবেশ চমৎকার। ছোটনাগপুরের পার্বত্য এলাকার প্রকৃতি যেমনটি হতে পারে। অজস্র বনসম্পদ। শাল পলাশ মহুয়ার যেন শেষ নেই, অজস্র হরীতকী আর অর্জুন গাছ ঘোড়া নিম আর গরগল। উঁচুনিচু প্রান্তর; কোথাও সেই অনুর্বর ভূমি ঢেউয়ের ফণার মতন মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে, কোথাও আনত নম্র হয়ে গেছে। মাটি শক্ত, কাঁকর আর নুড়িভরা, বাতাসে আর্দ্রতা নেই, শুকনো, বনগন্ধে পূর্ণ। গুরুডিয়ার কাঁচা রাস্তাটুকু ধরে কিছুটা এগিয়ে গেলেই সরকারি পাকা রাস্তা। এই রাস্তা ধরে তিনদিকে চলে যাওয়া যায়, দক্ষিণ আর মধ্য বিহারের অনেকখানি এই রাস্তার জালে জড়ানো। গুরুডিয়া থেকে রেল স্টেশনও এমন কিছু দুরে নয়, ব্যাপারীরা আসা-যাওয়া করে সবসময়।
সুরেশ্বর যা চেয়েছিল, নিরিবিলি শান্ত পরিবেশ, আশেপাশে দেহাত, নাগালের মধ্যে পথঘাট, যোগাযোগের সুবিধে–এখানে মোটামুটি তা সবই পেয়েছিল।
আশ্রম তৈরি করার আগে সুরেশ্বর কোথায় ছিল সে কথা এখানের কেউ জানে না। ঘোরাঘুরি সে অনেক করেছে তা অবশ্য বোঝা যেত। আজ প্রায় চার বছর সুরেশ্বর এখানে। প্রথমে থাকত শহরের দিকে, তারপর এল স্টেশনের কাছে। শহরে তার নানা রকমের যোগাযোগ ছিল। ক্রিশ্চান মিশনারিদের সঙ্গে, সেবাসঙ্ঘের কর্মীদের মধ্যেও তার মেলামেশা ছিল।
স্টেশনের দিকে যখন চলে এল সুরেশ্বর তখন থেকেই সে যেন কিছু খুঁজছিল। প্রথম প্রথম বোঝ যেত না সুরেশ্বর কী খুঁজছে। মনে হত, অধিকাংশ বাঙালিই এদিকে এলে যেমন করে–ঘরবাড়ি জমি বাগানসুরেশ্বরও তাই করবে, বরাবরের মতন থেকে যাবে। ক্রমে ক্রমে বোঝা গেল, সুরেশ্বর জমি জায়গা খুঁজছে অন্য উদ্দেশ্যে। অন্ধ আতুর জনের জন্যে কিছু করবে। কী করবে? হাসপাতাল না আশ্রম?
মনে মনে যা ভাবত সুরেশ্বর অন্যের কাছে তা প্রকাশ করত না। সামান্য যা করত তা থেকে স্পষ্ট কিছু বোঝা যেত না। অন্ধদের জন্যে তার এত বিচলিত হবার কারণ কী, সে যে কী করতে চাইছে তা কখনও বিস্তারিত করে বলেনি। প্রথমটা তার ব্যক্তিগত ব্যাপার; দ্বিতীয়টা সম্পর্কে তার ধারণা, যা সে করেনি, যা শুধুমাত্র তার ইচ্ছা তা বিস্তারিত করে বললে নিজের কল্পনাশক্তির পরিচয় দেওয়া হয়, তার বেশি আর কিছু নয়। সুরেশ্বর অলস স্বপ্ন দেখতে এবং তার বিবরণ শুনিয়ে কাউকে চমৎকৃত করতে পছন্দ করত না।