মন্তা আসছে। ওকে চলতে দেখলে কষ্ট হয়। ওর জন্য পারুলের নিশ্চয় দুর্ভাবনা রয়েছে। বিবিরও কি নেই গোরাকে নিয়ে!
‘আপনি ফিরে আসুন জেঠু, অন্ধকারে যাবেন না আর।’
‘না, যাব না। আচ্ছা মন্তা, শরৎ বসাকের বাড়িটা ঠিক কোন জায়গায় বলো তো? অন্ধকারে ঠাওর হচ্ছে না।’
‘ওই তো, ওই দিকটায়’ মন্তা হাত তুলে দেখাল। ‘বসাকদের বাড়ির সবাই তো মরে গেছে!’
‘সবাই মরে গেছে, মানে!’
‘একদিন রাত্তিরে ছেলেমেয়ে বউয়ের গায়ে তোশক জড়িয়ে কেরোসিন ঢেলে লোকটা আগুন ধরিয়ে দিয়ে, নিজেও গায়ে কেরোসিন ঢেলে দেশলাই জ্বেলে দেয়…কেউ বাঁচেনি।’
‘কেন? সবাইকে মেরে নিজে মরল! কারণ কী?’ খবরটা তাকে অসাড় করে দিচ্ছে। এই একজনের সঙ্গেই এখানে তার পরিচয় হয়েছিল। দুটো না তিনটে ছোটো ছেলেমেয়েকে তখন সে দেখেছে। বাবা জ্যান্ত তাদের পুড়িয়ে মেরে দিল, এ কি বিশ্বাস করা যায়!
‘আমি জানি না। পুলিশ এল, কত লোককে জিজ্ঞাসা করল।’
‘বাড়িতে কে আছে এখন?’
‘তালা দেওয়া, ওদিকে কেউ যায় না। …এবার চলুন। কথা না শুনলে মা রেগে যায়।’
‘তোমার মা খুব রাগী?’
‘ভীষণ।’
শরৎ বসাকের খবর শুনে তার মনে অস্থিরতা শুরু হয়েছে। আত্মহত্যা তাকে বিমর্ষ করে দেয়, আর এটা তো নিরীহ কয়েকজনকে হত্যা করে! সে এখন কোনো কিছুতেই আর আগ্রহ বোধ করছে না। প্রায় অর্ধেক মুড়ি শেষ হয়েছে, বাকিটুকু খেতে তার ইচ্ছা করল না। ফিরে আসার সময় সে অন্ধকারে মুড়িগুলো রাস্তার পাশে ফেলে দিল মন্তার নজর এড়িয়ে।
খালি গামলাটা দাওয়ার উপর রাখার সময় সে জিজ্ঞাসা করল মন্তাকে, ‘ভাত নিতে কখন আসব?’
‘রান্না আমার প্রায় হয়ে গেছে…আমরা তাড়াতাড়ি শুই।’ পারুল উত্তর দেয়।
.
স্টেশনারি দোকানে বড়ো বড়ো কোম্পানির প্যাকেটের চা পাওয়া যাবে, কিন্তু এইসব চা তার ভালো লাগে না। খুচরো লুজ চা বিক্রি হয় এমন দোকান সে খুঁজতে শুরু করল। গন্ধ আর লিকার এই দুটোর জন্য দু—রকম চা এক—একজন দোকানদার এত ভালো মেশাতে পারে! বাবা নিজে গিয়ে মজুমদারমশায়ের দোকান থেকে মেশানো চা কিনে আনত দু পাউন্ড করে, মাসে দু—বার। বাবা মোটরেই বসে থাকত, গলায় কণ্ঠি, ফতুয়া পরা মজুমদারমশাই চায়ের ঠোঙাটা গাড়িতে দিয়ে যেত নিজে, নমস্কার করত। বাবা বলত, ‘লোকটা অদ্ভুত ব্লেন্ড করে, একসময় চা—বাগানে কাজ করত।’
কাঠের ফার্নিচারের দোকানের বাইরে টুলে বসা লোকটাকে দেখে তার মালিক বলেই মনে হল। সে এগিয়ে গেল। ‘এখানে চা—পাতার দোকান আছে?’
‘চা—পাতার?…ওই সামনে যে সারের দোকানটা দেখছেন, ওর পিছনেই পাবেন।’
‘ধন্যবাদ।’
রাস্তা পার হয়ে হার্ডওয়্যার দোকান, তার পাশে সারের দোকান, একটা সরু গলি, ঢুকে প্রথম দোকানটাই ‘চা ঘর’। পাঁচ—ছ’টা লালরঙের টিন তাতে সাদা বড়ো অক্ষরে প্রত্যেকটায় ‘চা’ লেখা। দোকানি একজন খদ্দেরের জন্য চা ওজন করছে। সে দাঁড়িয়ে থাকল। পাশের ‘বিভূতি ফার্টিলাইজারস’ সাইনবোর্ডের দোকানের সামনে সাইকেল হাতে ধুতি আর হাতা গোটানো সাদা শার্ট পরা এক বছর—চল্লিশের লোক রাস্তা থেকে চেঁচিয়ে কথা বলছে। তার কান ওই দিকেই গেল।
‘কি বলছেন আপনি! বোরো আই আর ছত্রিশ এখন অবসোলিট হয়ে যাচ্ছে। এখন সুপারফাস্ট ধান পি এন আর এসে গেছে। আমি তো এবার পাঁচ বিঘেতে পি এন আর তিনশো একাশি লাগিয়েছি।’ দোকানের ভিতর থেকে একজন কী যেন বলল। হাতে সাইকেল ধরা লোকটি প্যাডেলে একটা পা রেখে হেসে বলল, ‘তিন মাসে বিঘেতে তেইশ মণ ফলনও পেয়েছে, আমি কুড়ি মণ পাব আশা করছি। …দেখাই যাক না।’
‘আপনাকে কী দোব?’ চশমাপরা, গোলগাল, নম্রভাষী চা—দোকানি জিজ্ঞাসা করছে।
‘দার্জিলিং বড়ো পাতা, হবে?’
‘বড়ো পাতা নেই, ফ্যানিংস আছে, নব্বুই টাকা কেজি।’
‘হাফ কেজি দিন।’ সে একটু অবাক হল, রথতলায় এখন নব্বুই টাকার চা পাওয়া যায় শুনে।
‘না দাদা, ঢ্যাঁড়শ, বেগুন নয়, এবার খালধারের জমিতে কপি লাগাব, …ইস্কুল করব, চাষও দেখব অত সময় কোথা! চলি বটুকদা।’ সাইকেল হাতে ধরে লোকটি হেঁটে চলে গেল।
‘এই যে আপনার চা।’
চায়ের ঠোঙায় প্যাকেটটা ঝুলিতে ফেলে সে সাইকেলওয়ালার খোঁজে রাস্তায় দাঁড়িয়ে এধার ওধার তাকাল। লোকটাকে তার দরকার। বোধহয় স্কুলমাস্টার, নিজে চাষ করায়, খোঁজখবর রাখে, এক্সপেরিমেন্ট করার সাহস আছে। লোকটিকে না পেয়ে সে স্টেশনারি দোকানে ঢুকল। দু প্যাকেট বিস্কিট, এক শিশি জ্যাম, একটা লুডোর পর একঠোঙা টফি কিনল। দরমার চালায় সারসার হাফপ্যান্ট, শার্ট, গেঞ্জি, ব্লাউজ, সায়ার দোকান। একটা ছাপছোপ মারা গোল—গলা গেঞ্জি ঝুলছে দেখে তার মন্তার কথা মনে পড়ল। ওর থেকে বছর দেড়েকের বড়ো গোরা। এই গেঞ্জিটা পরতে গেলে গোরার মাথাটাও গলবে না, মন্তার গায়ে ফিট করে যাবে। ছেলেটার শরীর বাড়েনি, বোধহয় অপুষ্টির জন্য। কিন্তু পারুল এমন দশাসই হয়ে গেল কী করে! সে গেঞ্জিটার সঙ্গে একটা হাফপ্যান্টও কিনল।
লোকটাকে সে দেখতে পেল সাইকেল নিয়ে ফলওয়ালার সামনে দাঁড়িয়ে। অনেকগুলো মুসম্বি লেবু থলিতে ভরে সেটা সাইকেলের হাতলে ঝোলাচ্ছে।
‘যদি কিছু না মনে করেন, একটা কথা জিজ্ঞাসা করব?’
দাড়িওয়ালা, কটা চোখের, দীর্ঘদেহী, অপরিচিত একজনের এহেন হঠাৎ প্রশ্নে লোকটি অবাক। ‘বলুন!’