অবিনাশের এক আত্মীয় পুলিশের পদস্থ অফিসার। তাকে সে অনুরোধ করেছিল জিনিসগুলো বিনা ঝামেলায় ফেরত পাবার জন্য। পরদিন শক্তিপদকে দাহ করে ফেরার সময় অনন্তকে সঙ্গে নিয়ে অবিনাশ থানায় যেতেই জিনিসগুলো কিঞ্চিৎ খাতিরসহই ফেরত পায়। অনন্ত একটা খাতায় সই করে জিনিসগুলো নেয়। তখন সে জানত না খামের মধ্যে চিঠিটা কার লেখা এবং তাতে কী লেখা। বাড়ি ফিরে প্রথমেই টাকার জন্য আলমারি খোলা হয়। তারপর সে বাবার জিনিসগুলো ও খামটিও লকারে রেখে চাবি বন্ধ করে দিয়েছিল। এরপর নানা কাগজপত্র বার করার জন্য লকার খোলা হয়েছে কিন্তু এককোণে প্লাস্টিকের মোড়কে সুতো দিয়ে বেঁধে—রাখা ওই জিনিসগুলো বা খামটিতে হাত আর দেওয়া হয়নি।
সাকসেশন সার্টিফিকেট বার করা, প্রভিডেন্ট ফান্ডের টাকা, এগারো দিন চাকুরির মাইনে, এ ছাড়াও জীবনবিমার তিন হাজার টাকা, সবই অবিনাশ সংগ্রহ করে দিয়েছিল। শীলাকে সঙ্গে নিয়ে কখনো—বা অনন্তকে নিয়ে সে ট্রামে, বাসে, ট্যাক্সিতে আদালতে এবং অফিসে অফিসে ঘুরেছে নিজের খরচে, ঘুস দেবার প্রয়োজন হলে নিজের পকেট থেকেই দিয়েছে।
‘আপনার ঋণ কীভাবে যে শোধ করব ঠাকুরপো…আমার ছেলেমেয়েদের উপর ভগবানের কী যে অসীম দয়া, না হলে এমন বিপদের দিনে কি আপনাকে পেতাম! তিনিই পাঠিয়ে দিয়েছেন আপনাকে।’
প্রভিডেন্ট ফান্ডের তেরো হাজার টাকার চেক নিয়ে নামার সময় শীলা যখন কথাগুলি বলছিল, প্রৌঢ় লিফটম্যানের মুখে তখন এক চিলতে হাসি দেখেছিল অনন্ত। জীবন সম্পর্কে নিশ্চিন্ত একটা ধারণায় পৌঁছবার পর মানুষ এমন বৈরাগীর মতো হাসতে পারে। অবিনাশের মুখেও একটা হাসি ফুটে উঠেছিল—কিছুটা আত্মসুখ, কিছুটা বিনয় ও উদবেগ মেশানো।
‘ও—সব পরে শুনব, আগে এই চারটে নাবালকের কথা তো ভাবতে হবে।’
এবার হাঁটতে হাঁটতে তারা সার্কুলার রোডে আসে।
‘চা খাবেন বউদি?’
‘আপনি খান, আমি দোকানের ছোঁয়াছুঁয়ি…’
বিধবা জীবনে শীলা অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছিল কয়েক সপ্তাহেই।
অবিনাশ চায়ের বদলে কোকাকোলা খেয়েছিল দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে। অনন্ত জীবনে সেই প্রথম এই পানীয়ের আস্বাদ পায়। তার ভালো লেগেছিল এবং তিন ভাই—বোনের কথা মনে পড়ে বিষণ্ণ বোধ করে।
‘শক্তিদার তো আরও বেশি থাকার কথা।’
‘হবে, আমি তো এ—সব খবর রাখতুম না। সংসারের টাকা আমার হাতে কখনো দিতেন না। ঝিয়ের মাইনেটাও নিজে হাতে দিতেন। আমি বরং কখনো—সখনো…’
অনন্ত জানে মা কেন থেমে গেছল। বাবা পায়খানা গেলে মা তার পকেট হাতড়ে বা মানিব্যাগ থেকে দু—তিন টাকা সরাত। একদিন সে দেখে ফেলেছিল। কাউকে সে—কথা সে বলেনি। বাবার নিশ্চয় সন্দেহ হত। মানিব্যাগ খুলে একদিন বাবাকে ভ্রূ কোঁচকাতে দেখেছিল। অনন্ত ভয়ে ভয়ে থাকত, হয়তো বাবা তাকে জিজ্ঞাসা করবে, ব্যাগে টাকা কমে গেল কেন? কিন্তু করেনি।
টাকা নিয়ে মা কী করত। অনন্ত স্কুল থেকে ফিরে একদিন দেখেছিল রাস্তায় সদর দরজার সামনে তিন—চারটি লঙ্কা—নুন—মাখা শালপাতা। কেউ আলুকাবলি বা ফুচকা খেয়েছে। কে খেয়েছে জিজ্ঞাসা করতেই মা থতমত খেত।
‘ওপরের মেজোবউ কি রত্না বোধহয়, প্রায়ই তো ডেকে ডেকে কিনে খায়।’
আর একদিন স্কুল থেকে ফিরে দেখল মা বাড়ি নেই। অমর তার আগে স্কুল থেকে পৌঁছে খেতে শুরু করে দিয়েছে।
‘মা কোথায় রে?’
‘অনু আর অলুকে নিয়ে সিনেমা গেছে।’
‘পয়সা পেল কোথায়? তুই জানলি কী করে?’
‘কে জানে কোথায় পেয়েছে, ওপরের জেঠিমা বলল।’
অলুর স্কুল সকালে, দশটার মধ্যেই সে বাড়ি ফিরে আসে।
‘অনু স্কুলে যায়নি?’
‘বোধহয় হাফ—ছুটি করে চলে এসেছে।’
‘তালা দিয়ে গেছল?’
‘ওপরে চাবি রেখে গেছে।’
ওপরে আছে বাড়িওয়ালার আত্মীয় এক পরিবার। বিশেষ মাখামাখি নেই। বাড়িওয়ালা থাকে শিলিগুড়ি। অনন্ত তাকে কখনো দেখেনি। ওপরের জ্যাঠামশাই আর তার ভাই বাড়িওয়ালার ভূমিকা নিয়েই বসবাস করে। তবে প্রতি মাসের পাঁচ তারিখে বাবা মানিঅর্ডারে ভাড়ার পঁয়ষট্টি টাকা শিলিগুড়িতে পাঠিয়ে দেয় জনৈক সুখরঞ্জন পোদ্দারের নামে। একবারের জন্যও পাঁচ তারিখের নড়চড় হয়নি। নামটা সে জেনেছে যেহেতু পোস্ট অফিসে গিয়ে মানিঅর্ডার করার ভার ছিল তার উপর। দু—বছর পর বাবা মারা যাবার তিন মাস আগে পঁয়ষট্টি হয়েছিল সত্তর।
বাবা পছন্দ করত না পাড়ার লোক বা আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে মেলামেশা বা ঘনিষ্ঠতা। কলকাতায় বউবাজারে আর জামশেদপুরে থাকে দুই মামা, কিন্তু সম্পর্ক নেই। যাদবপুরে কাকার রেস্টুরেন্ট আছে, অবস্থা ভালো, তার সঙ্গেও বাবার মুখ দেখাদেখি নেই। ঠাকুমা আর ঠাকুরদা ছিল কাকার সঙ্গে। দু—জনেই মারা গেছে। ভাইয়ের সঙ্গে বাবার যে কেন ঝগড়া, অনন্ত তা জানে না।
মা সিনেমা দেখত বা এটাসেটা কিনে খেত এবং সেজন্য কোথা থেকে পয়সা পেত, শুধু অনন্ত নয় তার ভাইবোনেরাও তা বুঝে গেছল। শীলা হয়তো সেটা জানত কিংবা জানত না। সে প্রায় নিরক্ষর এবং সরল আর অসম্ভব পরিশ্রমী। কিন্তু ছেলেমেয়েরা বাবার কানে তোলেনি। তারা মাকে ভালোবাসে।
কোকাকোলা খাবার পর সেদিন ট্রামে উঠে ওরা লম্বা সিটে পাশাপাশি বসেছিল। মাঝখানে শীলা।
‘দু—মাস আগে চার হাজার টাকা পি এফ থেকে তুলেছিলেন, ওরা খাতা থেকে আমায় দেখাল। কীজন্য, কিছু জানেন কি?’