অমিয়র বাড়ি রতন চেনে, দু-তিনবার গিয়েছে। অমিয়র বউ কমলাকে সে বউদি বলেছে। ঠান্ডা মৃদু স্বভাবের, তিন ছেলেমেয়ের মা। রবিবার নটা নাগাদ রতন হালসিবাগানে পৌঁছল বাড়ি থেকে হেঁটেই। ছোটোবেলায় পরেশনাথের মন্দির দেখতে হেঁটেই এসেছে, সেই পাড়াতেই অমিয় থাকে।
‘চা খাবি?’ অমিয় তখন খালি গায়ে লুঙ্গি পরে চা খাচ্ছিল।
‘না, সকালে এক কাপের বেশি খাই না,’ রতন বলল।
‘বাড়িওলা কাশিবাবুর সঙ্গে কাল কথা বলে রেখেছি। উনি রাস্তায় আমাদের জন্য দাঁড়িয়ে থাকবেন।’
‘রাস্তায় কেন?’
‘ঘরের খোঁজ করতে কেউ এলে রাস্তাতেই তাকে ধরে পাড়ার লোকে নাকি ভাংচি দেয়, ও ঘরে ভূত আছে। তাই উনি পাড়ার লোকের খপ্পরে পড়ার আগেই আমাদের আগলে রাখতে চান।’
‘কিন্তু আমি তো ভূত আছে জেনেই যাচ্ছি!’
‘সেটা তো পাড়ার লোকের কাছেই আমি শুনেছি, কাশিবাবু তো চেপে গেছেন। …আর শোন ভাড়া বলেছে সত্তর টাকা, এক বছরের অ্যাডভান্স, সেলামি চায়নি। আমি বলেছি আগে ঘর দেখি তারপর যা বলার বলব। তুই তড়বড়িয়ে কিছু বলতে যাবি না। চল এবার।’ অমিয় দড়িতে ঝোলানো পাঞ্জাবিটা টেনে নিল। কাশিনাথ ঘোষ বাড়ির সামনে রাস্তাতেই দাঁড়িয়ে। সদর দরজার পাশে সরু আড়াই হাত চওড়া মাটির গলি, ঠিক অনাথ স্যারের বাড়িতে ঢোকার গলিটার মতো। এটাই বাড়ির পিছন দিকে ভাড়াটের ঘরে যাবার পথ। সেই গলি দিয়ে কাশিনাথের পিছু নিয়ে তারা একটা তালাদেওয়া দরজায় এসে দাঁড়াল। দরজার দু-ধারে বন্ধ দুটো জানালা।
তালা খুলে কাশিনাথ পাল্লা দুটোয় ধাক্কা দিল। ভিতরটা অন্ধকার, ওরা স্পষ্টভাবে কিছু ঠাওর করতে না পারলেও দেখতে পেল একটা খাট আর দেয়ালে টাঙানো রাধাকৃষ্ণের ছবি। কাশিনাথ ভিতরে ঢুকে সুইচ টিপে আলো জ্বালল। কম পাওয়ারের বালব। ভ্যাপসা গন্ধ একটু কমল জানলা দুটো খুলে দেওয়ায়। ঘরে রোদ ঢোকে না। খাটে গদি বা তোষক নেই।
‘বুঝলেন, পুরো সংসারটাই ফেলে রেখে বউটা চলে যায়। জিনিসপত্তর যাই ছিল, কাপড়চোপড়, বাসনকোসন, বিছানা বালিশ আরও সব ছাতামাতা লোক ডেকে এনে বলি সব নিয়ে যা। কী হবে ওসবে আমার! খাটটাকে বিদেয় করিনি, ভাড়া এক বছরের বাকি রয়েছে, এটা বিক্রি করে যদি দুমাসেরও ভাড়া ওঠে!’
অমিয় আর রতন দেখে নিল, ঘরের লাগোয়া রান্না ঘরটা অর্থাৎ একদিক খোলা একটা তক্তপোশ রাখার মতো জায়গা। রান্নার জায়গার পাশের দরজাটা দিয়ে বেরোলেই উঠোন আর এজমালি কল-পায়খানা। অমিয় এক চোখ টিপে ইশারায় রতনকে জানিয়ে দিল, নেওয়া যেতে পারে।
‘কাশিবাবু ঘরটার কী যেন একটা বদনাম আছে শুনেছি।’ অমিয় এবার আসল কথায় এল। সে আগে ভেবে রেখেছে ভাড়া কমাতে ভূতের সাহায্য নেবে।
‘ও হো হো, আপনাদের কানেও ভূত ঢুকেছে?’ কাশিনাথের মুখচোখ তেতো গোলার মতো হয়ে গেল। ‘এ পাশের বাড়ির মলয় ধরের বদমাইশি, এই বাড়িটা কেনার জন্য দেড় বছর ধরে আমাকে টোপ দিচ্ছে। আমি বলেছি, না, আর যাকেই বেচি ওকে বেচব না। আরে মশাই আমার কি পয়সার অভাব! একটা মাত্র মেয়ে, বিয়ে দিয়ে দিয়েছি, আছি তো শুধু কর্তাগিন্নি। গিন্নির বাত, একতলায় সিঁড়ি ভেঙে নাবতে পারে না। দু-দিন বাদে মরে যাব, পয়সা কি আমার সঙ্গে সঙ্গে যাবে?…এই বাড়ি আমি দান করে দিয়ে যাব…ইনুভার্সিটিকে, মেডিকেল কলেজকে, ভারত সেবাশ্রমকে, তবু বেচব না, অন্তত ওই নতুন পয়সাওলাটাকে নয়।’ কাশিনাথের উত্তেজিত স্বর চিৎকারে পৌঁছল। ‘কত রটাবে রটাক, আমি পরোয়া করি না, ঘর যদি খালি পড়ে থাকে তো থাকুক তাতে কাশি ঘোষ না খেয়ে মরবে না।’
‘কিন্তু ভাড়াটে না পেলে তো মলয় ধরই জিতে যাবে, দানটান ছাড়ুন, বাড়ি তো মেয়েই পাবে। এই রতনই প্রমাণ করে দেবে ভূতটুত সব বাজে কথা। ভাড়াটা একটু কমান, পঞ্চাশ করুন আর অ্যাডভান্সটা ছ মাসের। …দাদা রাজি হয়ে যান। মলয় ধরের বদমাইসিটা লোক টের পেয়ে যাবে ভাড়াটে বসলে। আর খাটটা বিক্রি করবেন কেন, আপনার কি টাকার অভাব? ওটা বরং রতনকে প্রেজেন্ট করে দিন।’ অমিয় তার বলার ভঙ্গিতে দিলদরিয়া ভাব ফোটাল। কাশি ঘোষের দুর্বলতা যে কোথায় সেটা সে ধরে ফেলেছে। রতন যতই শুনছিল অমিয়র কথা ততই অবাক হচ্ছিল। মনে মনে সে স্বীকার করল, অমিয়দা না থাকলে সে কাশি ঘোষের সব দাবিই একবাক্যে মেনে নিত।
‘প্রেজেন্ট ফেজেন্ট করতে পারব না, একশো টাকা দিতে হবে,…কবে আসবেন? অ্যাডভান্স কবে দেবে?…মাসের সাত তারিখের মধ্যে ভাড়া চাই, বিলও আমি দোব।’ কাশি ঘোষের উত্তেজনার বাষ্প উবে গিয়ে অমিয়র কথাগুলো মাথায় জমাট বেঁধেছে।
‘কালই পোস্টাপিস থেকে টাকা তুলে সন্ধেবেলায় দিয়ে যাব।’ রতন ধড়মড় করে ঘুম থেকে ওঠার মতো ব্যস্ত হয়ে বলল।
‘আজ আষাঢ়ের ঊনত্রিশ, পয়লা শ্রাবণ থেকে তাহলে ভাড়া শুরু হবে…থাকবেন দুজন তো?’
‘এখন দুজন, পরে তিনজন হবে, তারপর চারজন হবে।’ অমিয় চোখ টিপল, নরম ধমকে রতনের চোখ ভুরু কুঁচকে উঠল। অমিয়দা ঠোঁটকাটা তাই বলে বাইরের লোকের সামনে!
ফেরার সময় হাঁটতে হাঁটতে অমিয় তাকে বলে দিল সংসার করতে হলে কী কী জিনিস তাকে এখুনি কিনতে হবে। রতনের মাথার সব দরজা জানলা তখন একে একে বন্ধ হয়ে যাচ্ছিল, অমিয়র কথাগুলো ঢোকার পথ পেল না। তখন চোরাবালিতে ডুবতে থাকা মানুষের মতো তার মনের অবস্থা। একটা কথাই বার বার তাকে হতাশার মধ্যে নামিয়ে দিচ্ছিল…তাহলে সত্যি সত্যিই এ বার সংসার থেকে বেরিয়ে আসছি! এবার একা তাকে চলতে হবে। এতকাল কাকা আর মা-র আড়ালে জীবন কেটেছে, বিপদে আপদে সে জানত, ওরা আছে। এবার আর ওরা থাকবে না। একটা ভয় তার বন্ধ মাথার মধ্যে ইঁদুরের মতো ছোটাছুটি শুরু করল। সে জানে এই ভয় শিবি কাটিয়ে দিতে পারবে না। সেদিন দুর্বল হয়ে বটতলার বিয়েটা না করলে আজ সে এমন অবস্থায় পড়ত না। নিজের উপর রাগ করে এখন আর আগের নিশ্চিন্ত জীবনে ফেরা যাবে না। সান্ত্বনার মতো সে নিজেকে শোনাতে লাগল, জীবন কি কখনো চিরকাল একরকম থাকে? কতরকম ভাবেই তো বদলায়! এটাও ধরে নেওয়া যাক একটা বদল। যা ঘটে গেছে, যাকে সে বদলাতে পারবে না তার সঙ্গে আপোশ করে চলতে পারলে বোধহয় ঝঞ্ঝাটমুক্ত জীবন পাওয়া যেতে পারে। ঝঞ্ঝাটকে সে বরাবরই এড়িয়ে চলেছে। সে শান্তি ভালোবাসে।