‘তোমাদের বাড়িতে আমাকে নেবে না আমি জানি।’ শিবি নিশ্চিত স্বরে বলল।
সেন্ট্রাল অ্যাভিনিউয়ে তারা পৌঁছেছে। রাস্তা পার হয়ে এখন কোথায় যাবে? দুজনে দাঁড়িয়ে পড়ল।
‘না, তোমাকে আমাদের সংসারে নেবে না। …কাল মাকে সব বলেছি আর বলেছি এরপর আমি বাড়িতে আর থাকব না।’
‘ঘর ভাড়া নেবে?’ ব্যগ্র হয়ে শিবি বলল। ‘মোনাকে বলব? ওর অনেক চেনাজানা আছে পাড়ায়।’
‘না। এ-তল্লাটে আমি আর থাকব না।’ অস্বাভাবিক কঠিন শুধু স্বরই নয় রতনের মুখের পেশিও শক্ত হয়ে উঠল।
‘সেই ভালো। আমিও তাই ভেবেছি। …চলো আমরা দুজনে দূরে কোথাও চলে যাই, যেভাবে রাখবে সেভাবেই আমি থাকব, তুমি যা রোজগার করে আনবে তাতেই সংসার চালাব, মনে শান্তি আর ভালোবাসা থাকলে কোনো অভাবকেই আর-‘
‘থামো, বোকার মতো কথা বলার সময় এখন নয়। শান্তি, ভালোবাসা যেন ছেলের হাতের মোয়া।’ রতন তার স্বভাববিরুদ্ধ রূঢ় গলায় ধমকে উঠল।
শিবি থতমত হল। রতন যে এভাবে ধমকে কথা বলতে পারে সেটা তার ধারণার বাইরে ছিল। রাতারাতি বদলে গেছে রতন। ওর নরম শান্ত চোখ দুটো রুক্ষ দেখাচ্ছে, গলার স্বরে জ্বালা। শিবির বুকের মধ্যে গুরগুর করে উঠল ভয়।
‘বাড়ি যাও, এভাবে রাস্তায় আমার সঙ্গে আর দেখা কোরো না। …আমার আত্মসম্মান বোধটা আছে…সেটা আমি কাল খুইয়েছি। ওটা আবার আমি ফিরে পেতে চাই।’ দাঁতে দাঁত চেপে ধরায় রতনের মুখে হিংস্র ভাঁজ পড়ল।
‘মা আমাকে বেরিয়ে যেতে বলেছে। আমি কোথায় যাব?’ অনুনয় জানাল শিবি। চোখ ছলছলে হয়ে উঠেছে। ‘মা আমার জন্য ছেলে জোগাড় করেছিল, মদের বার-এ কাজ করে। আমি রাজি হইনি। লোকটা দু নম্বরি, মুখ্যু, মুখে শুধু খারাপ কথা। তোমার ধারেকাছেও আসে না। …আমি রাজি হইনি।’ শিবি দু-হাতে রতনের হাত ধরল, দু-চোখে জ্বলজ্বলে প্রত্যাশা। তার চোখ বলতে চায়, আমি কি ভুল সিদ্ধান্ত নিয়েছি?
এটা কলকাতার একটা বড়ো রাস্তার মোড়। রতন ঝাঁকানি দিয়ে শিবির হাত দুটো ফেলে দিল। সেই কাণ্ডজ্ঞানহীন মেয়েটা, কোথায় কেমন ব্যবহার করতে হয় জানে না। মুখে বিরক্তি ফুটিয়ে রতন বলল, ‘রাজি হওনি ভালো কথা…এ বার বাড়ি যাও। আমার কপালে যা লেখা আছে তা হবেই। দোষ তোমায় দিচ্ছি না…আমিও তো এখন নিমিত্তের ভাগী।…’
শিবির মুখ চোখ বদলে গেল। অসহায় নিরাশ্রিত করুণাপ্রার্থীর মতো ভঙ্গিটা নিমেষে অন্তর্হিত হল। নাক কুঁচকে চোখ দুটো ছোটো করে চাপা খরখরে গলায় বলল, ‘বিয়ে বিয়ে খেলায় খেলুড়ে হতে গেলে কেন? কে তোমায় মাথায় দিব্যি দিয়েছিল? আমাদের বাড়িতে যেতে কেন? শিবানি দত্তর বুক চোরের মতো তো দেখতে…আমি কিছু বুঝি না ভেবেছ?…ঢ্যামনাপনা যদি করো তা হলে আমি ছ্যাচ্ছাড়িয়ে তোমার বাড়ির সামনে রাস্তায় দাঁড়িয়ে সব বলব। …সম্মান আমারও আছে।’ শিবি এক পা এগিয়ে রতনের মুখের কাছে মুখ নিয়ে দাঁতের খই ছড়িয়ে দিয়ে বলল, ‘পনেরো দিনের মধ্যে ঘর জোগাড় করে আমাকে নিয়ে যাবে…ঝুপড়ি হোক, বস্তি হোক সব আমার কাছে রাজপাসাদ। মনে থাকে যেন তুমি ভদ্দরলোকের ছেলে।’
কথাগুলো বলেই শিবি সেন্ট্রাল অ্যাভিনিউয়ে নেমে সোজা তাকিয়ে রাস্তা পার হবার জন্য হাঁটতে লাগল। একটা মোটর বাইক আর একটা ট্যাক্সি শব্দ করে ব্রেক কষে তার দু গজ দূরে থেমে পড়ল। ট্যাক্সি ড্রাইভার অশ্লীল গালাগাল দিল। দৃকপাত না করে শিবি হনহনিয়ে রাস্তা পার হল। স্তম্ভিত রতনের চোখ যতক্ষণ পারল তাকে অনুসরণ করল। সে অনুভব করতে শুরু করল, ওই কালো মেয়েটার রক্ত মাংস মেদমজ্জা চটকে, দলা পাকিয়ে তার খেয়ে ফেলতে ইচ্ছে করছে। শিবি তার শরীরে রক্ত চলাচলের বেগ বাড়িয়ে দিয়েছে। যখন তখন বদলে যায় এমন প্রকৃতির এই মেয়েটাকে সে কখনোই বোধহয় গুছিয়ে বুকের মধ্যে জড়ো করতে পারবে না।
চোরের মতো দেখতুম? রতন পাথরের মূর্তির মতো ফুটপাথে দাঁড়িয়ে রইল। একটা রাগ তার পা থেকে কপাল পর্যন্ত দাউ দাউ করে উঠে গেল। একটা নীচু ঘরের, অশিক্ষিত, বাজে রুচির মেয়ে তাকে ধরে ফেলেছে। তার ভিতরের নীচ হীন প্রবৃত্তিটা শিবি দু আঙুলে চিমটের মতো ধরে বার করে এনে বোঝাতে চাইল সে একটা নোংরা লোক। কোন সাবালক পুরুষমানুষ না মেয়েদের বুকের দিকে তাকায়? এটা কি হীন নোংরা ব্যাপার? রতন ধন্দে পড়ে গেল। একটা জ্বালা তাকে জ্বালাতে লাগল, বোধহয় আমি দুশ্চরিত্র! মা আর দিদিকে বয়সের একটা সময় পর্যন্ত তার সামনে শরীরের আব্রু নিয়ে মাথা ঘামাতে সে দেখেনি। সেও সচেতন ছিল না কিন্তু সেটা অল্পবয়সের কথা।
শিবিকে আমি ছাড়তে পারব না, সেই বড়ো রাস্তার মোড়ে দাঁড়িয়ে রতন সিদ্ধান্তে পৌঁছল। ওকে মা আর থাকতে দেবে না, তা হলে যাবে কোথায়? তারই তো ওকে দেখার কথা। যেমন ভাবেই বিয়েটা হোক, সে তো শিবির স্বামীই। বেচারা, অসহায়! ওর হুমকিতে ভয় পেয়ে নয়, সে অদ্ভুত একটা মমতা শিবির জন্য বোধ করছে বলেই ঠিক করে ফেলল পনেরো দিনের আগেই তাকে ঘর জোগাড় করে ফেলতে হবে।
কিন্তু কীভাবে খুঁজে পাবে ঘর ? দালাল লাগিয়ে পাওয়া যেতে পারে কিন্তু কোনো দালালকেই সে চেনে না। পাড়ায় আঠারো নম্বর বাড়ি আধবুড়ো, লম্বাচুল, রোগা একটা লোক শুনেছে বাড়ির দালালি করে। লোকটাকে বলার চিন্তা সে সঙ্গে সঙ্গে ঝেড়ে ফেলল। পাড়ার লোককে বললে জানাজানি হয়ে যাবে। নিজে খোঁজ করা যেতে পারে কিন্তু সময় কোথায়! বর্ধন প্রেসের চেনাজানা লোকেদের অবশ্য বলা যেতে পারে। অমিয়কে তার মনে পড়ল। হালসিবাগানে ঘর ভাড়া করে ছেলে-বউ নিয়ে থাকে, করিতকর্মা মিশুকে লোক, তাকে ভালোবাসে। ওকে বললে নিশ্চয় একটা ঘরের ব্যবস্থা হয়ে যাবে। সেলামি, অ্যাডভান্স ভাড়া না দিলে ঘর পাওয়া যাবে না। প্রেসের কাছেই আমহার্স্ট স্ট্রিট পোস্ট অফিসে হাজার চারেক টাকা জমিয়েছে, মা বা কাকা তা জানে না। খুব কম ভাড়ার ঘরের জন্য অমিয়দাকে সে বলবে।