রাস্তার আলো জ্বলে গেছে। সন্ধ্যার মুখে লোক চলাচল বাড়ে। কেউ ওদের লক্ষ করল না। মিনিট দুয়েক হেঁটে, পাথরের টালি বসানো একটা গলিতে মোনা তাকে ঢোকাল। দু-ধারে খোলার চাল দেওয়া মাটির ঘর। একটা বুড়ো বট গাছ। তার তলায় ইটের একটা পাকা ঘর। দরজার উপরে টিমটিমে একটা বালব। সামনে ছোটো একটা সিমেন্টের চাতাল। ঘরটাই মন্দির, তার মধ্যে সিঁদুর মাখানো আধ হাত একটা কালো পাথর সিমেন্টে পোঁতা। পিছনে একটা ত্রিশূল। রতন দেখল খালি গায়ে ধুতি পরা এক বৃদ্ধ পুরোহিতের সাদা দাড়ি, লম্বা চুল, মোটা পৈতে, কপালে সিঁদুর। চাতাল ঘিরে মলিন বসন পরা কিছু স্ত্রীলোক, শিশু, কিশোরী। ওরা বিয়ে দেখতে ভিড় করেছে। রতন শুনল, ‘ছেঁড়া ময়লা জামা পরে বিয়ে কত্তে এয়েচে, কেমন বর গো!’ ‘হোক ছেঁড়া ময়লা, বরের মুখটা খুব মিষ্টি।’ রতন দেখল, চৌকো বাক্সের মতো পিতলের সিংহাসনে বসানো শালগ্রাম শিলা; এক জোড়া মোটা গোড়ের মালা; বেলপাতা আর বাসি ফুল চাপানো একটা পিতলের ঘট; পিলসুজে বসানো প্রদীপ। ঘটের দু-ধারে চাতালে শিবির মুখোমুখি মোনা তাকে বসাল। শিবির পরনে লাল ফুলের ছাপ দেওয়া পুরোনো সিনথেটিক শাড়ি। মুখে চকচক করছে ঘাম। দ্রুত চিরুনি চালানো চুলে আলগা খোঁপা। সে সোজা রতনের মুখের দিকে তাকিয়ে, ব্রীড়ার কোনো আভাস তার ভঙ্গিতে নেই। রতন মুখ নামিয়ে রাখল।
মোনার তাড়ায় দশ মিনিটও লাগল না বিয়ে ঢুকে যেতে। ঘটের উপর রতনের হাতের উপর শিবির হাত, পুরোহিত সম্ভবত সংস্কৃতেই মন্ত্র পড়ল, তিন-চারটে শুকনো কুশের আঁটি জ্বালানো হল, ধোঁয়ায় ছেয়ে গেল বটতলা। কাক ডেকে উঠল, ভিড়ের থেকে কাশির শব্দ উঠল আর তারই মধ্যে বসা অবস্থাতেই মালা বদল করল দুজনে।
‘সিঁদুর সিঁদুর,…সিঁদুর পরাবে না?’ ভিড়ের মধ্য থেকে কে ব্যস্ত স্বরে বলে উঠল।
কাঁখালে মেয়ে সামলাতে সামলাতে মঙ্গলা কাঠের সিঁদুর কৌটো খুলে রতনের সামনে ধরে বলল, ‘বোয়ের সিঁথেয় মাখিয়ে দাও। এটাই হল আসল বিয়ে…তোমাকে আমার ধম্মোপত্নী কোল্লুম, লাগাও, চওড়া করে লাগাও।’ মঙ্গলা উলু দিল। সঙ্গে সঙ্গে ভিড়ের মধ্য থেকে তিন-চারজন উলু দিয়ে উঠল। বিয়ে হয়ে গেল!
শিবমন্দির ফাঁকা হয়ে যেতেই মোনা বলল, ‘কুড়িটা টাকা দে শিবি, আজকের সুবদিনে বিলিতি খাব।’
‘টাকা? হাত খালি করে চুড়ি দিয়েছি, আংটি দিয়েছি, বিক্রি করে কত টাকা পেয়েছিস হিসেব দে।’
‘শিবি ওকে একটাও পয়সাও দিস না’ কাতর স্বরে মঙ্গলা বলল, ‘মদ খেলেই ও আমায় ঠ্যাঙায়।’
‘আমি না থাকলে তোর কী বিয়ে হোতো? …ব্রাদার তো তোর পেট করে দিয়ে কেটে পড়েছিল, আমিই তো ধরে আনলুম।’
‘কী বললি…কী বললি…আর একবার বল…তোর মাস্তানি ছুটিয়ে দোব যদি ওর নামে অমন নোংরা কথা বলবি।’ দু-হাতের দশটা আঙুল বাঁকিয়ে, সাদা দাঁতগুলো বার করে শিবি বলল। ‘তোরা শুধু পেটই দেখিস আর একটু ওপরে উঠে মনটাকে দেখতে পারিস না?’ শিবি হাত ধরল রতনের। আর একটি কথাও না বলে সে টেনে নিয়ে চলল তার সদ্য হওয়া স্বামীকে। গলি থেকে বেরিয়ে গোলাপ দত্ত লেনে পড়ে শিবি মাথার উপরে আঁচল তুলে ছিল। রতন সেই যে বলেছিল ‘এভাবে বিয়ে করব না, ছেড়ে দাও আমাকে’ তারপর থেকে একটি কথাও বলেনি। এখনও নির্বাক রয়েছে। শুধু গলা থেকে মালাটা খুলে নিয়ে হাতে দলা পাকিয়ে রেখেছে।
ততক্ষণে কেউ কেউ জেনে গেছিল। তারা শিবির বর দেখার জন্য বাড়ির দরজায় দাঁড়িয়ে। ছয়ের-বি গলির মুখে দাঁড়িয়েছিল বীণা। রতনকে দেখে তার ভ্রূ কুঁচকে উঠল। বহু বছর ওকে সে দেখেনি। তবু চিনতে পারল আর ‘ওম্মা, রতন না?’ বলে গালে হাত দিল।
‘চেনো নাকি গো?’ সামনের বাড়ির দরজা থেকে এক প্রৌঢ়া বলল।
‘চিনব না! রতন তো ওনার কাছে পড়তে আসত। …ছেলেটা যে এভাবে গলায় দড়ি দেবে কে ভেবেছিল…ভদ্দরঘরের বামুনের ছেলে!’
শিবি সদর দরজায় তালাচাবি দিয়ে বেরিয়েছিল। দরজার সামনে শিব্যির মা দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছে।
‘এতক্ষণ মরতে কোথায় গেছিলি?’ রাগে ঝাঁঝিয়ে উঠল শিবির মা।
‘বিয়ে কত্তে গেছলুম…এই তোমার জামাই।’ স্বাভাবিক গলা শিবির।
কথা সরল না শিবির মার মুখে। দুজনের মুখের দিকে বারবার তাকাতে লাগল। তখনই রতনের মাথার মধ্যে দমকলের ঘণ্টা বেজে উঠল। শিবির মায়ের চোখ ধিকধিক জ্বলছে। যে-কোনো মুহূর্তে হুশ করে একটা কেলেঙ্কারি জ্বলে উঠবে।
‘হঠাৎ করে হয়ে গেল। …বটতলা শিবমন্দিরে মন্তর পড়ে-।’
শিবির কথা অসম্পূর্ণই রয়ে গেল। তার মা মুঠোয় চুল ধরে মাথাটা টেনে নামিয়ে চিৎকার করে উঠল, ‘পোড়ারমুখী, হঠাৎ করে?…এ ভাবে নিজের সব্বোনাশ করলি!’
এই সময়ই দলা পাকানো মালাটা হাত থেকে ফেলে দিয়ে রতন পিছন ফিরে প্রায় ছুটেই গোলাপ দত্ত লেনে পৌঁছল। তারপর হনহন করে হেঁটে সেন্ট্রাল অ্যাভিনিউয়ে এল। রাস্তায় গাড়ির স্রোত, পার হতে না পেরে সে অপেক্ষায় রইল। তার মাথায় সাড় ফিরে এসেছে। এখন সে ভাবতে পারবে, তাকে এখন ভাবতে হবে। অবিশ্বাস্য একটা কাজ সে করে ফেলেছে!
ভাবার জন্য, ট্রাম লাইন পেরিয়ে মিনিট দুয়েক হেঁটে সে চিলড্রেন্স পার্কে এসে বেঞ্চে জায়গা না পেয়ে ঘাসের উপর বসল। অনেক লোকই বসে আছে কিন্তু তার মতো একা কাউকে সে দেখতে পাচ্ছে না। তরুণ পাঠাগারে বই নিতে আসত একটা লোক তাকে সে চিনতে পারল, সঙ্গে দুটি বাচ্চচা। ঘাসে বসে চিনেবাদাম ভেঙে বাচ্চচা দুটিকে খাওয়াচ্ছে। লোকটা কি এখনও বই পালটাতে যায়? দিন দশেক সে নিজে চৈতন্য লাইব্রেরিতে যায়নি, কাল যেতে হবে। কাল সে বর্ধন প্রেসেও যাবে। পায়ে এখন আর কোনো ব্যথা নেই। …শিবি এ কী করল! এখন আমি কী করব? কী ভাবব আমি এখন! সর্বনাশ যা হবার তা তো হয়েই গেছে।