‘নিশ্চয় করব।’ বলার সময় রতনের চিবুক একটু উঠল। স্বরে একটু তেজ এসে গেল। তাকে যেন শিবি পুরুষমানুষ ভাবে।
‘ভদ্দরলোকেরা ধাপ্পা মারে।’
‘আমি ধাপ্পা মারার লোক নই…বিশ্বাস করো, অন্তর থেকে বলছি।’
রতন দেখল শিবির মুখ মন্থরভাবে বদলে যাচ্ছে। যে চোখ নাক ঠোঁট বিশ্রীভাবে ছড়িয়ে পড়েছিল সেগুলো যথাযথভাবে গুছিয়ে এসে মুখটাকে কুঁড়ি ভেঙে ফুটে ওঠা একটা ফুলের মতো করে তুলছে। কালো মার্বেলের মতো চোখ দুটোয় সন্ধ্যাবেলার স্তিমিত আলো ফুটে উঠছে। শিবি ঢোঁক গিলল, ওর গলার পেশিতে এক পশলা বৃষ্টি ঝাপটা দিল।
‘তোমার মন বদলে যাবে…তোমার মনের জোর কম।’ শিবি ফিসফিস স্বরে বলল, ‘বলো বদলাবে না, ভয়ে পিছিয়ে যাবে না?’ রতনের একটা হাত তুলে নিয়ে আঙুলগুলো মুঠোয় চেপে ধরল। ‘আমি খুব খারাপ মেয়ে, লেখাপড়া জানি না, কথাবার্তা খারাপ, দেখতে খারাপ। শরীর ছাড়া আর কিছু নেই…সবাই ওটাই চায়। আমার মন বলছে তুমি আমায় সত্যিকারের ভালোবাসো।’
‘তোমার মন ঠিকই বলেছে।’
শিবির চোখ জ্বলে উঠল। ‘তা হলে এখুনি আমাদের বিয়ে হবে।’ বলেই সে তালি দিয়ে ঘর থেকে বাইরে ছুটে বেরিয়ে দড়াম শব্দে দরজা বন্ধ করে দিল। শিকল তোলার আওয়াজ পেল রতন। এখুনি বিয়ে হবে, মানে? রতনের খটকা লাগল। ঘাড় জ্বালা করছে, শিবি পৈতেটা খুব জোরেই টেনেছিল। বাড়ি ফেরার সময় গন্ধেশ্বরী ভাণ্ডার থেকে পৈতে কিনে নিতে হবে। মেঝেয় বোতাম খুঁজল। ঝিনুকের বোতাম একটা ভেঙে গেছে, অন্যটা খুঁজে পেল না। সে জানলায় এসে দাঁড়াল। কানাগলিতে লোক চলাচল হয় না তবে তিনটে বাচ্চচা মেয়ে এক্কা-দোক্কা খেলছে। রতন জানলা বন্ধ করে দিল। শিবির খোঁজ করতে এসে কেউ যদি জানলায় উঁকি মারে? অন্ধকার ঘরে সে বিছানায় শুয়ে কপালে হাত রেখে ভাবতে শুরু করল, শিবি বিয়ের কথা বলে ছুটে গেল কোথায়? ফাঁকা একটা পরের বাড়িতে এভাবে ঘরে বন্দি হয়ে থাকা ভালো দেখায় না। শিবির মা যদি এখন এসে পড়ে? বাইরে সদর দরজা তো খোলা রয়েছে।
ঘরের ভিতর রোদ আসে না। রতন তোশক থেকে ভ্যাপসা গন্ধ পাচ্ছে, বালিশে নারকেল তেলের গন্ধ। শিবি অমন করে ছুটে বেরোল কেন, সেই চিন্তা করতে করতে সে সিদ্ধান্ত নিল, ওকে এবার কড়া কথা বলতে হবে। খুবই বাড়াবাড়ি করল পৈতে ছিঁড়ে দিয়ে। হঠাৎ মাথার মধ্যে কী যে হয়ে গেল, লোকে বলে ঠান্ডা চাপা স্বভাবের অথচ নিজেকে সে ধরে রাখত পারল না! হুট করে বিয়ে করব বলার আগে সাতপাঁচ ভেবে দেখা উচিত ছিল। সামাজিক দিক দিয়ে, শিক্ষাদীক্ষায় শিবি কী তার যোগ্য? ওর মধ্যে সে কী এমন দেখতে পেয়েছে যে জন্য ওকে সারা জীবনের সঙ্গিনী করতে সে ব্যাকুল হয়ে উঠেছে? তা ছাড়া কাকা বা মা যদি শোনে? ভাবা যায় না কী ঘটবে!
চিন্তার ভারে রতনের মাথা ক্লান্ত হতে লাগল। জল তেষ্টা পেয়েছে। ঘরে কোথাও জল পাওয়া যাবে কি না, সেটা খুঁজে দেখতে হবে। বিছানা ছেড়ে উঠতে তার ইচ্ছা করছে না। কোথাও থেকে কোনো শব্দ আসছে না। ঘরটা তাকে অসাড় করে দিচ্ছে। তন্দ্রা নামছে চোখে। কতক্ষণ কেটে গেল! ঘণ্টা দুই, দেড়, এক কি হবে? সে প্রায় ঘুমিয়ে পড়েছিল হঠাৎ তার মনে হল ঘরের বাইরে যেন গলার আওয়াজ শুনল। উঠে বসার আগেই শিকল খুলে শিবি ঘরে ঢুকল। তার পিছনে মঙ্গলা আর জংলাছাপের হাওয়াই শার্ট, ফুলপ্যান্ট পরা একটি বলিষ্ঠ যুবক।
‘ব্যবস্থা হয়ে গেছে, চলো শিগ্গিরি। মংলাদের পাড়ায় বটতলা-শিবের মন্দিরেই বিয়ে হবে। মোনা পুরুতমশাইকে বলে এসেছে। শালগ্রাম সাক্ষী রেখে মালাবদল আর সিঁদুর পরিয়ে দেবে।’ শিবি উত্তেজনায় ফুটছে। তার চোখ দুটো আরও গোল হয়ে জ্বলজ্বল করছে। কথাগুলো বলল এক নিঃশ্বাসে।
‘পুরুত বলল আগুনের ব্যাওস্তা ও করে দেবে একস্ট্রা পাঁচ টাকা লাগবে। আমি বলে দিয়েছি করুন, অগ্নিসাক্ষী থাকলে বিয়েটা আরও পাকা হবে।’
রতনকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকতে দেখে মোনা এবার তার কাঁধ ধরে ঝাঁকুনি দিল। ‘আরে ব্রাদার, বিয়ে তো একটা ছোটো ব্যাপার অত ঘাবড়াচ্ছ কেন? চলো চলো।’
রতনের বাহু ধরে মোনা টেনেই তাকে ঘর থেকে বার করল।
‘তোরা যা আমি কাপড়টা বদলেই যাচ্ছি।’ শিবি বলল, ‘মোনা ওকে ধরে থাকিস।’
‘না, …না।’ রতন হাত ছাড়াবার চেষ্টা করে পারল না। মোনার গায়ের জোর তার প্রায় দ্বিগুণ। ‘এভাবে বিয়ে করব না। …ছেড়ে দাও আমাকে।’
‘ঠিক আছে ব্রাদার, শিবির সিঁথেয় সিঁদুরটা তো আগে লাগিয়ে দাও তারপর যেভাবে তোমার ইচ্ছে সেইভাবেই বিয়ে কোরো। মেয়েটাকে ফাঁসিয়ে দিয়ে এখন পালাবার ফিকির করো না।’
রতনের বাহুতে মোনার মুঠো শক্ত করে চেপে বসল।
‘ফাঁসিয়ে দিয়ে মানে!…ব্যাপারটা কী?’ রতন দাঁড়িয়ে পড়ল। ভয়ে তার হাঁটু কেঁপে উঠল, এ কী কথা!
‘ফাঁসানো মানে জানো না? মুখ দিয়ে খারাপ কথা বার করাবে? দুপুরে, একটা মেয়ে ছাড়া বাড়িতে কেউ নেই…চলো চলো।’
এরপর রতনের শরীর ছাড়া আর সব কিছু থেকে কাজ করার ক্ষমতা লুপ্ত হয়ে গেল। সে শুনছে, দেখছে তার হাতে ব্যথা লাগছে কিন্তু কিছুই তার মস্তিষ্কে কম্পন তুলে আসল জায়গায় আঘাত করছে না। সিনেমা স্লাইডের ছবির মতো মাথা থেকে সরে সরে যাচ্ছে দৃশ্য। গোঙানির মতো একটা শব্দ সে শুনতে পাচ্ছে গলার কাছে। ঢোঁক গিলে সেটাকে নামানো যাচ্ছে না। তার পা দুটো তাকে হাঁটিয়ে নিয়ে যাচ্ছে কিন্তু হাঁটতে তার সায় নেই। সম্পূর্ণ অপরিচিত পরিবেশ কিন্তু দেখার কোনো কৌতূহল নেই। সে বেঁচে থেকেও বেঁচে নেই।