‘কী বলতে এসেছ?…বসো।’
খাটে পা ঝুলিয়ে বসল রতন। শিবির ঠান্ডা স্বর আর চাহনি থেকে সে বুঝে গেছে রাগ পড়েনি। ‘যে এসেছিল তাকে যেন আগে দেখেছি।’
‘দেখতে পারো। মঙ্গলা তো ভেতর দিকে আটাশ নম্বর বস্তিতে থাকে। রাস্তায় খুব ঘুরত। বস্তিরই মোনা নামে একটা ছেলেকে প্রেম করে বিয়ে করেছে।’
‘রাস্তায় নয়, তোমার এই জানলায় দাঁড়িয়ে কথা বলেছিল। মনে নেই আমি তখন ন্যাড়া মাথা, বাবার শ্রাদ্ধের ঠিক পরই।’ রতন আশা নিয়ে তাকাল।
কয়েক সেকেন্ড কড়িকাঠের দিকে তাকিয়ে শিবি চোখ রাখল রতনের মুখে। ‘যেদিন তুমি বললে বিলেত না কোথায় যাবে? ওখানে হপ্তায় দু-আড়াই হাজার টাকা লোকে মাইনে পায়?’
‘হ্যাঁ হ্যাঁ।’
‘উড়োজাহাজে যাবে সঙ্গে আমাকেও নিয়ে যাবে।’ গলায় বিদ্রূপ শিবির।
রতনের মনে আছে, শিবি বলেছিল ‘ঠিক?’ সেও বলেছিল ‘ঠিক।’ তখন আচমকা শিবি তার গালে চুমু খেয়ে বলেছিল ‘এমনি যাব না, বিয়ে করে নিয়ে যেতে হবে।’ শিবির কি কথাটা এখনও মনে আছে?’
‘ও সব ছেলেবয়সের আবোলতাবোল স্বপ্ন, সবাই দেখে।’ ঝেড়ে ফেলার মতো ভঙ্গিতে কোলের উপর বালিশ টেনে নিয়ে রতন তাতে চাপড় দিল। ‘তুমিও তো তখন বলেছিলে, বিয়ে করবে আমাকে তবেই যাবে।’ রতনের ঠোঁট ছড়িয়ে পড়ল।
‘আমার মনে আছে। বয়স কম ছিল বলে মনে আছে।’ শিবির কঠিন ভাবটা নরম হয়ে এল। জানলা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে থেকে বলল, ‘তখন কিছু বুঝতুম না, সবই বিশ্বাস করতুম।’
‘এখন করো না?’
উত্তর না দিয়ে শিবি বলল, ‘কী বলতে এসেছ?’
‘কাকার সঙ্গে ঝগড়া হয়ে গেছে, কথা বলা বন্ধ। সত্যিই খুব অন্যায় করেছে তোমাকে ছোটো জাত বলে। …ডোম মুচি বলা একদমই উচিত হয়নি। লোকটা বরাবরই ওই রকম, ছোটোবেলা থেকেই তো দেখছি। …তুমি কিছু মনে কোরো না, হাত জোড় করে আমি মাপ চাইছি।’ রতন করজোড়ে মিনতি জানাল।
‘কে তোমার মাপের ধার ধারে!’ শিবির গলার স্বর এখনও ঠান্ডা কিন্তু চোখে স্ফুলিঙ্গ বেরোল। রতন এই রকম উত্তরই পাবে আশা করেছিল।
‘আমি শোধ নেব, তোমার কাকার থোঁতামুখ ভোঁতা করে দোব। আর তোমার এই নেকু নেকু কথাও আমি ঘোচাব। উঁচু জাত বলে অহংকার? জাতের বড়াই করা?’ শিবি কোমরে আঁচল জড়িয়ে গুঁজল।
‘আমি কিন্তু জাতটাত মানি না।’
‘মানি না!’ ভেংচে উঠল শিবি। ‘যদি না মানো তা হলে আমার এঁটো খাও।’ শিবি দু-পা এগিয়ে এসে রতনের সামনে দাঁড়াল। রতনের হাঁটুতে স্পর্শ করল শিবির ঊরু। ‘আমার এইখানে ঠোঁট ছোঁয়াও।’ শিবি নিজের ঠোঁটে আঙুল দিয়ে দেখাল, ‘ছোঁয়াও।’
রতনের হতভম্ব হওয়ার কথা। কিন্তু হল না। এই হচ্ছে আসল শিবি। ওর সঙ্গে পরিচয় হওয়ার প্রথম দিন থেকেই সে জেনে গেছে শিবির কাণ্ডজ্ঞানটা কম। কখন কোথায় কী বলতে বা করতে হয় সেই বোধটাই নেই। রতন হাসল।
বেড়ালের বিদ্যুদগতি থাবার মতো দুই কাঁধে দশটা নখ বসিয়ে তাকে টেনে ধরে হাঁ করে শিবি রতনের দুটো ঠোঁট মুখের মধ্যে ভরে নিল। এত অকস্মাৎ ব্যাপারটা ঘটে গেল যে, বিস্ময়ের ধাক্কায় রতন অসাড় হয়ে রইল। সে শুধু তীক্ষ্ন ব্যথা পাচ্ছিল দুই কাঁধে আর ঠোঁট দুটো মনে হচ্ছিল ছিঁড়ে যাবে। আধ মিনিট পর শিবি রেহাই দিল। ঠোঁট চেটে রতন ঢোঁক গিলল। শিবি তার মুখের মধ্যে থুথু ঢুকিয়ে দিয়েছে। স্বাদটা নতুন, সে উত্তেজনা বোধ করল।
‘কী গো বামুনের ব্যাটা, ডোম মুচির মেয়ের থুতু তো গিললে। যাও এবার কাকাকে গিয়ে বলো!’ শিবি হেসে উঠল। হাসি শেষ হবার আগেই রতন দু-হাতে শিবিকে বুকে টেনে নিয়ে বলল, ‘তোমাকে আমি বিয়ে করব…করবে?’
‘এক্ষুনি করবে? …বলো?’
‘হ্যাঁ এক্ষুনি।’ রতনের শরীরে যেন একশো পাঁচ ডিগ্রি জ্বর। ভুল বকার মতো সে বলল, ‘আমি মেনিমুখো নই…পুরুষমানুষ। কাউকে আমি ভয় পাই না।’ শিবিকে সে ঠেলে সরিয়ে দিল।
‘আমি পুরুষমানুষকে বিয়ে করব, উঁচু জাতকে নয়। পৈতে খোলো…খোলো।’ শিবি দু-হাতে শার্টের গলা ধরে হ্যাঁচকা টান দিতেই দুটো বোতাম ছিঁড়ে শার্টের গলা ফাঁক হয়ে গেল। হাত ঢুকিয়ে শিবি পৈতেটা ধরে টেনে বার করল। হাতের কাছেই টেবিলের উপর রুমালের কাপড় আর সুতোর সঙ্গে রয়েছে একটা কাঁচি। হাত বাড়িয়ে শিবি কাঁচিটা তুলে নিয়ে, রতন বাধা দেবার আগেই, পৈতেটা কেটে দিল। শার্টের ভিতর থেকে ছেঁড়া সুতোর গোছা টেনে পরে নিয়ে সে নিজের গলায় পাক দিয়ে জড়িয়ে হি হি করে মজা পাওয়ার হাসি হেসে উঠল।
‘এবার আমি বামুন হয়েছি…বামুন বামুন বামুন হয়েছি।’ দু-হাত মাথার উপর তুলে সুর করে ‘বামুন বামুন’ বলে, কোমর দুলিয়ে দুলিয়ে খ্যামটা নাচ শুরু করল শিবি। রতনের স্তম্ভিত ভাবটা কাটতে একটু সময় লাগল। সেদিনের অপমানের শোধ যে এইভাবে তুলবে সে বুঝে উঠতে পারছে না। শিবি তার কাছে অস্পষ্ট একটা হেঁয়ালি হয়ে উঠছে।
‘আমি এসেছি মাপ চাইতে, আর তার বদলে কী ব্যবহার করলে!’ রতনের গলায় রাগের বদলে নরম ক্ষোভ অনেকটা অভিমানের মতো ফুটে উঠল। শিবির নাচ থেমে গেল।
‘খুব খারাপ ব্যাভার করেছি! যদি মারতে ইচ্ছে হয় তো মারো।’ রতনের একটা হাত তুলে নিয়ে শিবি নিজের গালে আঘাত করল।
‘ভদ্দরলোকেরা মেয়েদের গায়ে হাত তোলে না।’ যথাসাধ্য ভারিক্কি দেখাবার চেষ্টা করল রতন।
‘তুমি ভদ্দরলোক? ভদ্দরলোকেরা কথা রাখে…কথা দিয়েছ এক্ষুনি বিয়ে করবে।’