‘রতু চুন হলুদ গরম করে এনেছি, লাগবি না?’
‘না। ব্যথা নেই আর।’
সাত
পরদিন সকালে রতন খুঁড়িয়ে হেঁটে সামনের বাড়ি গেল। ছোটুদা এখন হাওড়ার একটা কলেজে পড়ায়। বছর দুয়েক আগে ফোন নিয়েছে। বাইরের ঘরে ছোটুদা দুটি ছেলের সঙ্গে কথা বলছিল। ওরা পড়তে আসে। রতন বলল, ‘একটা ফোন করব অফিসে।’
‘করো।’ টেলিফোনে তালা দেওয়া। চাবি দিয়ে ছোটুদা খুলে দিল।
অফিসে নয়, অক্ষয় বর্ধনের বাড়িতে সে ফোন করল। পেয়ে গেল অক্ষয়কে। ‘জ্যাঠামশাই, কাল ট্রাম থেকে পড়ে গিয়ে পা মুচকেছে, হাঁটতে পারছি না।’ রতন কখনো এর আগে ছুটি নেয়নি, একমাত্র দিদির বিয়ের সময় ছাড়া। অক্ষয় তাকে সাত দিনের ছুটি মঞ্জুর করল।
‘তোমার খবর কী রতন, আর তো দেখতেই পাই না।’ ছোটুদা বলল। মোটা হয়েছে, মাথায় টাক পড়তে শুরু করেছে। এখনও বিয়ে করেনি।
‘খবর আর কী, সেই থোড় বড়ি খাড়া জীবন, চলে যাচ্ছে।’ রতন ভাবল, টেলিফোন কলের জন্য পয়সা দিতে গেলে ছোটুদা কি নেবে?
‘বড্ড তাড়াতাড়ি চাকরিতে ঢুকে গেলে। ম্যাট্রিক পাশ করে কলেজে পড়তে পারতে।’
রতন কুঁকড়ে গেল ‘ম্যাট্রিক পাশ করে’ শুনে। ছোটুদা জানে না তা হলে।
‘ভাবছি প্রাইভেটে প্রি-ইউ দোব। … আপনাকে কিন্তু তখন জ্বালাব।’ রতন স্বস্তির হাসি মুখে ছড়াল।
‘নিশ্চয় নিশ্চয়। তোমাদের সবাই ভালো আছে? …সেদিন হাওড়ার গুমটিতে তোমার ভগ্নিপতিকে দেখলুম, বোধহয় ওখানে স্টার্টার না টাইমকিপার কী একটা যেন।’
‘আপনি কথা বললেন?’
‘না আমার তাড়া ছিল তা ছাড়া আলাপও তো নেই। দিদির আর বাচ্চচাটাচ্চচা হয়নি?’
ফিরে আসার সময় সে কাকার সামনে পড়ল। বিষ্ণু তখন অফিসে বেরোচ্ছে। দু-জনেই নিথর চোখে সামনে তাকিয়ে পরস্পরকে অতিক্রম করল।
‘মা চুন-হলুদটা একটু জল দিয়ে আবার গরম করে দাও।’ চেঁচিয়ে কথাটা বলে রতন বিছানায় এসে শুয়ে পড়ল। এখনই যত রাজ্যের ভাবনার সময়। কাকাকে ছোটোলোক বলে সে কি অন্যায় করেছে? বাড়িতে বাইরের একটা মেয়ে প্রথম এসেছে। তার সঙ্গে কোনো পরিচয়ই নেই, তার সম্পর্কে কিছুই জানে না অথচ তাকে বলেছিল মুচি না ডোম! বলারও একটা ভঙ্গি থাকা উচিত। রান্নাঘরে ঢোকার জন্য কি জাত যায়? অফিস করে, পাঁচটা লোকের সঙ্গে মেশে, বি এ পাশ, তবুও কাকার মধ্যে আচার বিচার সংস্কার মানার ব্যাপারটা রয়ে গেছে! এটাকে আঁকড়ে থেকে কী পায়?
শিবি তার সম্পর্কে যা ধারণা করল সেটা তো সে বলেই দিল-‘মেনিমুখো, মিচকেপোড়া!’ মেনিমুখো কথাটার মানে কী? ফট করে ও বলে দিল ‘মাগিবাড়ি যান।’ মেয়েদের মুখে ‘মাগি’ শব্দটা বিশ্রী শোনায়। শিবি একেবারেই লেখাপড়াটা করেনি, ভদ্র শিক্ষিতদের সঙ্গে মেশেনি। ওর বোধহয় ধারণা বিয়ে না করলেই পুরুষরা ওই সব জায়গায় যায়। কাকা যে যায় না, তা সে তামাতুলসী ছুঁয়ে বলতে পারে। আঘাতের পালটা আঘাত দেবার জন্যই ও বলেছিল আর লোকটা সম্পর্কে কিছু না জেনেই। অন্যায় করেছে শিবি। তবে প্রথম অন্যায়টা কাকার করা না হলে শিবি ফোঁস করে উঠত না।
রতন পক্ষে বিপক্ষে যুক্তি সাজিয়ে শিবিকে নির্দোষী প্রমাণ করার চেষ্টা করল চারদিন ধরে এবং তার মধ্যেই বুঝতে পারল, হোক সে অশিক্ষিত রুচিহীন, এই কালো মেয়েটাকেই সে ভালোবেসে ফেলেছে। মনে দরদ আছে শরীরে আছে আকর্ষণ। শিক্ষা বা রুচি নিয়ে বাছবিচার করার ইচ্ছে তার ভেসে গেছে, জীবনে এই প্রথম একজনকে আঁকড়ে ধরে সে পুরুষমানুষের মতো তীরে উঠতে চায়।
পায়ে খুব সামান্যই ব্যথা। রতনের অসুবিধা হল না শিবিদের বাড়ি পর্যন্ত হেঁটে যেতে। দুপুরে নির্জন পাড়া। রাস্তার কোনো চেনা লোকের সঙ্গে তার দেখা হল না। রতন দরজার কড়া নাড়ার আগে শিবিদের ঘরের জানলাটা খোলা দেখে এগিয়ে গেল। দেখতে পেল জানলার দিকে মুখ করে শিবি খাটে বসে কথা বলছে একজন স্ত্রীলোকের সঙ্গে। তাকে দেখে শিবি জানলায় উঠে এসে বলল, ‘কী চাই?’
‘কিছু না এমনিই…ইচ্ছে হল, তাই।’
চোখ কুঁচকে শিবি তাকিয়ে রইল। রতন অস্বস্তিভরে বলল, ‘সেদিনের ব্যাপারটা…কিছু বলার আছে।’
‘দাঁড়াও।’
স্ত্রীলোকটি উঁকি দিল শিবির ঘাড়ের পেছন থেকে। রতনের মনে হল মুখটি যেন চেনা-চেনা! সদর দরজা খুলে শিবি ডাকল, ‘এসো।’
তারা ঘরে আসতেই স্ত্রীলোকটি মেঝে থেকে সাত-আট মাসের একটা বাচ্চচাকে কোলে তুলে বলল, ‘তাহলে আমি আসি রে সিবি। পরে আসবখন।’
‘সিবি’ শুনেই রতন চিনতে পারল। জানলা দিয়ে এই মেয়েটাই বলেছিল চিত্রলেখায় দেবানন্দের বই হচ্ছে। সেদিন ওরা দুজন আর তিনটে লোক চিত্রলেখায় ম্যাটিনি শোয়ে গিয়েছিল। একজনের নাম ছিল ভেলোদা, সেই টিকিট কেটেছিল। মেয়েটার শরীর বাচ্চচাটার মতোই অপুষ্টি আর অভাবের আঁচড়ে জিরজিরে।
‘ঘরে থাকবি তো এখন?’ শিবি বলল।
‘তা না হলে মরতে আর যাব কোথায়?’
‘সন্দের সময় পারলে যাব তোর কাছে।’ শিবি ওকে নিয়ে ঘর থেকে বেরোল। সদরে খিল দেওয়ার শব্দ হল। শিবি উঠোনের তার থেকে শুকনো কাপড় আর সায়া তুলে ঘরে এল। ইতিমধ্যে রতন ঘরে চোখ বুলিয়ে নিয়েছে। এর আগে দু-বার সে এই ঘরে এসেছে আট বছর আগে। মনে হল তখন যতটা পরিপাটি আর যত জিনিসপত্র দেখেছিল এখন আর ততটা নেই। তোশক ঢাকা নীল চাদরটা ময়লা, বালিশের ওয়াড়ও তাই। রেডিয়োটা নেই। মশারিতে দুটো তাপ্পি। দেওয়ালে কয়েক জায়গায় নোনা ধরেছে। অবস্থা খারাপ হওয়ার চিহ্ন ঘরে ছড়ানো।