তারক ভাবল, এত ছোটো উত্তর শুনে হিরণ্ময় খুশি হবে না। ধারণাটা যাতে ভালো হয় সেইরকম কিছু বলা উচিত।
‘চাকরি আর সংসারের ঝামেলার মধ্যে থেকে খেলা সম্ভব নয়। অফিস তো আর খেলার জন্য মাইনে দেবে না।’
‘ছুটির দিন তো খেলতে পারেন।’ হিরণ্ময় সহানুভূতি দেখাল। তারক ভাবল একে বোঝানো যাবে না খেলাটা তার কাছে শখের ব্যাপার নয়। তা ছাড়া খেলা নিয়ে কথা বলতেই এখন ক্লান্তি আসে। ‘একবার যা ছেড়ে দিয়েছি, তা আর ফিরে ধরা সম্ভব নয়। এখন মনে হয় খেলার সময়টুকুতে দু-পয়সা রোজগারের চেষ্টা করলে লাভ হবে। খেলে তো দেখেছি, কী হয়?’
তারককে কয়েক মুহূর্তের জন্য কাতর দেখাল। হিরণ্ময় দেশলাই কাঠিটা বাক্সে ভরে রেখে বলল, ‘শুধু আপনি একা নন। লক্ষ লক্ষ লোক আজ আপনার মতোই হতাশ হয়ে পড়েছে। বাঁচবার জন্য, দুটো পয়সা রোজগারের জন্য মানুষ তার আনন্দগুলোকে বাতিল করে দিচ্ছে।’
ঘোড়ার ডিম করছে। তারক বিরক্ত হয়ে ভাবল খালি বাঁধা বুলি আওড়ান। লক্ষ লক্ষ লোকের মধ্যে ফেলতে না পারলে যেন ওর কথা বলাই হয় না। ওই তো বোসদা দিব্যি আনন্দ করছে। কী বাতিল করার আছে ওর! ও আর আমি হিরণ্ময়ের কাছে লক্ষ লক্ষ লোকেরই দু-জন। দুটো সংখ্যা। লক্ষ লক্ষ থেকে আমি বাদ পড়লে কেউ টেরও পাবে না। কিন্তু বাদ না দেওয়াতেই হিরণ্ময়ের আনন্দ।
‘কাল থাকছেন তো।’
‘নিশ্চয়।’
তারক ভাবল, এখনি যদি নারানের কথাটা বলি তাহলে বোকার মতো কাজ হবে। লক্ষ লক্ষের একজন ধরে নিয়ে আমার প্রতি যে করুণাটা ওর মধ্যে তৈরি হচ্ছে ভেঙে যাবে। একদিন মিছিলে চিৎকার করলে যদি কাজটা করে দেয়, তাহলে নারানের জন্য চিৎকার করতে আপত্তি নেই।
তারক ঘড়ি দেখে উঠে দাঁড়াল।
‘চললেন?’
হিরণ্ময় নিছক পোশাকি গলায় বলল না। ‘গোলাজাত’ বা ‘বাতিল’ ধরনের শব্দগুলো যেরকম ধাতব, কঠিন করে বলে, সে তুলনায় খুবই বাস্তব এবং আটপৌরে। তারকের মনে হল ওকে পটানো যাবে। তাক বুঝে বললে নিশ্চয় চেষ্টা করবে। তবে লক্ষ লক্ষ লোকের একজন হতে পারলে আরও নিশ্চিন্ত হওয়া যায়।
তারক ক্যান্টিন থেকে বেরিয়ে পেচ্ছাপখানায় গেল এবং ইঞ্জেকসান নেবার কথা ভাবতে ভাবতে বেরিয়ে এল। অথচ প্যান্টের বোতাম খোলার সময়ও লক্ষ লক্ষ লোকের একজন হওয়ার চিন্তাই মগজে ছিল। জ্বালা করে উঠতেই লক্ষ লক্ষ লোক, কয়েক লক্ষের পেনিসিলিন হয়ে গেল। সাতদিনের একটা কোর্স নিলেই ভালো হয়ে যাব এবং আজ থেকেই নেওয়া শুরু করতে হবে, এই কথাটা মনে মনে আবার ঝালিয়ে নিয়ে সে কাজে বসল।
পনেরো মিনিটের মধ্যেই সে বুঝে গেল কাজ এগোচ্ছে না। যত সহজ ভেবেছিল ইঞ্জেকসান নিয়ে সারিয়ে ফেলবে, এখন মনে হচ্ছে মোটেই তত সোজা নয়। কোথায় কার কাছ থেকে নেবে? কী হয়েছে, কেন হল, কোত্থেকে হল এন্তার প্রশ্নের জবাব দিতে হবে। তাহলে অহীনকেই তো বলা যায়। অহীন অবাক হবার ভান করে মনে মনে নিশ্চয়ই হাসবে। লোপ্পাই ক্যাচে ফেলে বালক সঙ্ঘের সঙ্গে জেতা ম্যাচটা হারিয়ে দিতে টেনে চড় কষিয়েছিলুম। হয়তো এখন ভোলেনি। বউকে গল্প করতে করতে নিশ্চয় বলবে- আমাদের পাড়ারই, একসঙ্গে ছোটোবেলায় কত খেলেছি। রোজ তো আমাদের বাড়ির সামনে দিয়েই অফিস যায়। দেখলেই চিনতে পারবে। প্রায়ই খয়েরি একটা টেরিলিন প্যান্ট আর হাওয়াই সার্ট পরে, বাঁদিকের কাঁধটা উঁচু করে হাঁটে, বেঁটে, ফর্সা, আর পাঁচটা লোকের মতোই দেখতে। খেলত ভালোই, একবার বেঙ্গল টিমে টুয়েলফথ ম্যান হয়েছিল। ওর যে এমন অধঃপতন হবে ভাবতেই পারা যায় না।
বউটা নিশ্চয়ই বলবে, টুয়েলফথ ম্যান আবার কী গা? অহীন বোঝাবার জন্য বললে-থপথপে অহীন, স্টান্স নিয়ে ব্যাটের হ্যান্ডেলটা তলপেটে চেপে, পোঁদটা ডেঁয়ো পিঁপড়ের মতো তুলে যেন হুমড়ি খেয়ে পড়ত, চোখ বুজে ফরোয়ার্ড খেলত, সেদিন পর্যন্তও জানত না মেয়েদের কোথা থেকে ছেলে বেরোয়, সেই আহাম্মকটা বউকে বোঝাবে টুয়েলফথ ম্যান কাকে বলে!
তারক হিজিবিজি কাটছিল কাগজে। একদৃষ্টে কাগজটার দিকে তাকিয়ে কতক্ষণ বসেছিল খেয়াল নেই, সামনে একজন এসে দাঁড়াতেই চমকে মুখ তুলল।
‘ওহ, নারান এসেছ, বোস।’
ব্যস্ত হয়ে তারক কাগজটা দলা পাকিয়ে ঝুড়িতে ফেলল।
‘এমন দেরি করে বললে, ইন্টারভিউয়ের লিস্ট তো তৈরি হয়ে গেছে। এ জি এমের কাছে বোধ হয় কালই পাঠানো হবে।’ নারানের চোখে ঝকঝকে রংটার ম্লান হওয়া লক্ষ করল তারক। তাইতে দুঃখ পেয়ে সে ভাবল, সবে বাইশ বছর বয়স মাত্র। কেন যে কেরানি হতে চায়!
‘তবে এখনও হাতছাড়া হয়নি। একজনকে বলেছি, সে পারে নাম ঢুকিয়ে দিতে। অ্যাপ্লিকেশন করে এন্ট্রি করা হয়েছে, এ জি এম সেটা নাও চেক করতে পারে। তবে কী জানো, জোর করে তো বলতেও পারা যায় না, ইংরিজিতে এত কম নম্বর পেয়েছ।’
নারান মাথা নামিয়ে আঙুল দিয়ে টেবলের উপর কিছু একটা মকশো করা শুরু করল। তারক বুঝতে পারল না সেটা বাংলা চার কী পদ্ম ফুলের পাপড়ি।
‘তোমাদের বাড়িতে তো সবাই ভালো ইংরিজি জানে, তবে তুমি এত কাঁচা হলে কী করে?’ তারক ভর্ৎসনার সঙ্গে অনুযোগও মিশিয়ে দিল, যাতে স্নেহের সুরটা কানে প্রথমেই বাজে।
‘বাবা মারা যাবার পর কী হল জানেনই তো।’ নারান নীচু স্বরে চোখে চোখ না রেখে যেভাবে বলল তাতে তারক আবার কষ্ট পেল। এই বয়সে এমন স্বরে কেন কথা বলে!