গৌরাঙ্গ কৌতূহলী চোখে তাকে লক্ষ করছে। প্রিয়ব্রতর মনে হল, ওই দুটো চোখ ক্যামেরার মতো তার মনের ছবি তুলে মুহূর্তে ডিভেলাপ করে, প্রিন্ট তুলে ওকে দেখিয়ে দিচ্ছে। দেখে মজা পাচ্ছে। খামটার দিকেও তাকাচ্ছে। ও কি জানে খামের মধ্যে যা রয়েছে সেটা ওর বাবাকে দেবার জন্যই রাখা! ড্রয়ারটা সে বিরক্ত ভরে জোরে ঠেলে বন্ধ করল। খট করে শব্দ হল কাঠের সঙ্গে কাঠের ধাক্কা লাগার। প্রিয়ব্রত চমকে মুখ তুলল।
”যেজন্য এসেছি।” গৌরাঙ্গ ঝুঁকে গলা বাড়িয়ে, টেবিলের সঙ্গে মুখ প্রায় ছুঁইয়ে ফিসফিস করে বলল, ”বাবার ওটা নিতে এসেছি।”
”কোনটে!” প্রিয়ব্রতর মুখ থেকে শব্দটা বেরিয়ে আসার পরও সাঁই সাঁই আওয়াজ বেরোতে লাগল। হাতুড়ির মতো কিছু একটা মস্তিষ্কের কোষে ঘা মেরে তাকে অসাড় করে দিয়েছে।
”বাবার মাসকাবারিটা…প্রিয়ব্রত নাগ যেটা দিতেন। এবার থেকে ওটা আমিই…।”
প্রিয়ব্রত আর কিছু শুনতে পাচ্ছে না। সারা অফিস ঘর আবছা হয়ে আসছে। ফণী পাল তাহলে মরেনি! ওর প্রেতাত্মা এখন তার সামনে বসে। অন্ধকার, সব অন্ধকার লাগছে। ওই মশার টুপি পরা সরল হাসিমুখটা, গভীর মনোযোগে ফাইলে তাকিয়ে থাকা মুখটা, অফিসারদের খোপ, টেবল, দরজা, সিঁড়ি ধীরে ধীরে তার চোখ থেকে মুছে যাচ্ছে।…লোডশেডিং! একটা হা-আ-আ রব তার বুকের মধ্যে উঠেই থেমে গেল।
নৈঃশব্দ।
প্রিয়ব্রত হাতড়ে হাতড়ে এগোতে গিয়ে ধাক্কা খেল। মঙ্গলার মুখ, হিতুর মুখ, জ্যাঠাদের বাড়ির সবার মুখ তার পথে ছড়ানো।
”নাহ।”
”ওটা কি এখন আপনার দিতে-”
”কীসের মাসকাবারি?”
”বাবা যেটা নিতেন!” গৌরাঙ্গর গালের মাংস শক্ত হয়ে উঠল।
”সেটা বাবাই নেবেন, আপনি কে?
দ্বিতীয় জগৎ, দ্বিতীয়বার শুরু করা…ধ্বংস করতে ফণী পাল একে পাঠিয়েছে। নরম হয়ো না, আত্মসমর্পণ করো না। তার বুকের মধ্যে একটা স্বর ভিক্ষা চাইছে।…যা পেয়েছ আর হারিয়ো না।
”এখনও রিটায়ার করতে তো আপনার চার পাঁচ বছর বাকি। বাবা বলে গেছেন, ততদিনই আপনি দেবেন।…তাতে আপনার মঙ্গলই হবে।” গৌরাঙ্গর স্বর এবং মুখ কঠিন হচ্ছে।
”না। আমার মঙ্গল আর চাই না। আপনি আসুন।”
”ভেবে দেখুন। বুঝতে পারছি আপনি শকড হয়েছেন। সময় নিন ভাববার…ব্যস্ত হবার কিছু নেই। আমরা কেউই তো আর মরে যাচ্ছি না বা পালাচ্ছিও না। আপনাকে অফিস করতে হবে আমাকেও স্কুলে যেতে হবে। অবশ্য একটা ছেলে ছাড়া আপনার আর কেউ নেই আমার সাতটা ছেলেমেয়ে, মা, বউ রয়েছে।…তাহলে কবে আসব, কাল?”
প্রিয়ব্রত মাথা নাড়ল।
”পরশু?”
”কোনোদিনই না।”
”হুট করে না বলবেন না, ভাবুন একটু।” গৌরাঙ্গ যেন অনুনয় করল। পাঁচশো টাকা, বিনা পরিশ্রমে মাসে মাসে পাওয়ার এমন সুযোগ সে হারাতে চায় না।
”বছরে ছ’ হাজার, পাঁচ বছরে তিরিশ হাজার। আপনি যদি থোক পঁচিশ হাজার দিয়ে দেন তাহলে কথা দিচ্ছি কোনোদিনই আর আমার মুখ দেখতে পাবেন না।”
স্বদেশ এল।
”অতুলদা, সেই চিঠিটা। টাইপ করে দিয়েছি।”
স্বদেশ একবার গৌরাঙ্গর মুখের দিকে তাকিয়ে ভৌমিকের টেবিলে গিয়ে বসল। প্রিয়ব্রত খাম থেকে চিঠিটা বার করে খুলে ধরল।..ভৌমিক আর স্বদেশ মাথা নিচু করে ফিসফিসিয়ে কথা বলছে। কী বলতে পারে? গৌরাঙ্গর কথাগুলো কি ওই টেবিল পর্যন্ত পৌঁছেছে? ভৌমিকের কান খুব তীক্ষ্ন, চোখও। অফিসারদের নোটে পটপট বানান ভুল ধরে ফেলে।
ওরা দুজন উঠে ঘরের বাইরে যাচ্ছে। কেন? এই সময় টেবল ছেড়ে বাইরে যাওয়ার মতো কী দরকার পড়ল ভৌমিকের? প্রিয়ব্রত ঘড়ি দেখল। ছুটি হতে আর পনেরো মিনিট বাকি।
”আমি আর কিছু বলব না। আপনি আসুন।…প্রায় এক লাখ টাকা আমি আপনার বাবাকে দিয়েছি।”
”আর তো মোটে কয়েকটা বছর, মেরে তো এনেছেন!”
গৌরাঙ্গর আবার সরল মুখ। ও কি বুঝতে পেরেছে আমি ভয় পেয়েছি। ওকে ”না” বলে দিলে কি হুমকি দিয়ে গলা চড়াবে? ভৌমিক নেই কিন্তু অন্য কেউ শুনে ফেলতে পারে।
সে মুখ ফিরিয়ে বারান্দার দরজার দিকে তাকিয়ে রইল। লোকটার মুখের দিকে তাকাতে ভয় করছে। সকাল থেকে রাত পর্যন্ত মাস্টারি করে সংসার চালাচ্ছে, ঘরেও অত্যন্ত অসুখী। পাঁচশো টাকা কিছুতেই হাতছাড়া হতে দেবে না। ও দিনের পর দিন আসবে, সামনে থাকবে, নিচু গলায় বলবে, ‘কিছু কি ঠিক করলেন?’ উঠে যবার সময় আবার বলবে ‘তাহলে কাল-।’ কিন্তু ওরও তো ধৈর্যের সীমা আছে!
একদিন ডিরেক্টরের খাস পিয়ন সুখেন্দু এসে বলবে, ‘সাহেব আপনাকে ডাকছেন।’ সে জানে ডাকটা কীজন্য। হাতের ফাইল বন্ধ করে, ড্রয়ারে চাবি দিয়ে সে চেয়ারটা নিঃশব্দে ঠেলে উঠে দাঁড়াবে। আড়চোখে ভৌমিকের দিকে অবশ্যই একবার তাকাবে। নিশ্চয় ও তখন মুখ নামিয়ে কাজে ব্যস্ত থাকবে। পরে সুখেন্দুর কাছে জেনে নেবে সাহেব কেন অতুলবাবুকে ডেকেছিল? ডিরেক্টর কাউকে ডেকে পাঠালে সুখেন্দু তখন নানা ছুতোয় ঘরে থেকে যায়। সব শোনে আর অফিসে ফিসফিস তারপরই শুরু হয়।
দোতলায় ডিরেক্টরের ঘরে ঢোকার আগে সে মোটা পাপোশটায় নিশ্চয় জুতো ঘষবে। ছাব্বিশ বছরে সে কতবার এই ঘরে ঢুকেছে? সাতজন ডিরেক্টর সে দেখেছে। প্রথম তিন-চারটে বছর তো এইঘরের ডাক পাওয়ার মতো যোগ্যতাই তার ছিল না। একটা টেবিলে সে আর অমল চাটুজ্যে মুখোমুখি বসত।
বারান্দার দরজা থেকে মুখ ফিরিয়ে সামনে তাকিয়ে প্রিয়ব্রত দেখল, গৌরাঙ্গ চলে যাচ্ছে। ঘর থেকে বেরিয়ে সিঁড়ির মাথায় পৌঁছে একবার মুখ ফিরিয়ে তাকাল। ওর চাহনিতে অবসাদের ভাব। হয়তো চোখের ঝোলানো পাতার জন্যও হতে পারে। চেয়ার থেকে উঠে সে বারান্দায় গিয়ে দাঁড়াল।