ভালবাসা জিনিসটা শিক্ষিত-অশিক্ষিত রুচির ওপর নির্ভর করে না। কাবেরীকে তার ভাল লেগেছিল। কাবেরী এখন কলেজে পড়ে, কিন্তু সে শিক্ষিত নয়। কিন্তু তাই ব’লে ভালবাসতে কি অরুচি হয়েছিল? আসলে ভালবাসা কথাটাই ঘোরপ্যাঁচে। তার থেকে ভাললাগা কথাটাই ঠিক। কাবেরীকে ভাল লেগেছিল তার শরীরের জন্য। এই ভাললাগা থেকেই কি ভালবাসা আসে? চুলোয় যাক ওসব কথা। বিশ্ব যদি চাকরি পায় আর রমাকে বিয়ে করে, সে ওরা ভালবাসুক বা না বাসুক তাতে কিছু এসে যায় না, তাহলে ওদের মেলামেশার সুযোগ দেওয়া উচিত। কথাটা শুনলে মাধবী চীৎকার করবে হয়তো।
এক গাল ধোঁয়া ছেড়ে চিনু সেই দিকে তাকিয়েই বলল:
-সর্টহ্যাণ্ড শিখছিলে না?
-হ্যাঁ।
-ভাল। অনেক সুবিধে আছে।
-কই আর সুবিধে হচ্ছে।
যে-কোন দোকানীকে ব্যবসায় লাভ হচ্ছে কিনা জিজ্ঞাসা করলে সে বিশ্বর মত সুরে আর ভাষায় জবাব দেবে। জীবনটাকে এরা ভাবে কি ? বিরক্ত হতে শুরু করল চিনু। দোষটা বিশ্বর না তার পরিবেশের? কিন্তু এই একই পরিবেশের মধ্যে সে নিজেও তো রয়েছে! তাহলে কি গঠনের তারতম্য? চিনুর চোখ বিশ্বর মাথায় এসে পড়ল। সাধাসিধে চুল আঁচড়ান। চুলগুলোকে গুছিয়ে নেবার জন্য চিনু মাথায় হাত বুলোলে একই গড়ন বোধ হয়। যে উপাদানে মানুষ গড়ে ওঠে সেটা খুলির মত বোঝা যায় না। অন্ততঃ বাইরে থেকে বোঝা যায় না। পৃথিবীটাকে আজও সহ্য করা যায় শুধু এইজন্য যে মানুষগুলো একই ধরনের নয়। সত্যিই কি নয়? একটা মেয়েকে দেখে একটা ছেলের মধ্যে কি কি অনুভূতি, আবেগ তৈরি হয়? কাবেরীকে দেখে যে রকম মনে হয়েছিল, বিশ্বর মধ্যেও কি তাই হচ্ছে না রমাকে দেখে?
হঠাৎ ক্লান্তি বোধ করতে শুরু করল চিনু।
-খাওয়া হয়নি বোধ হয়। আচ্ছা যাও আর আটকে রাখব না।
বিশ্বকে যাবার অনুমতি দিয়ে চিনু নিজেই লম্বা পায়ে চলে গেল। দোতলার বারান্দা থেকে কে যেন কেশে উঠল। রমার দিকে তাকিয়ে হাসতে যাচ্ছিল বিশ্ব, চোখ তুলেই নামিয়ে নিল। রোদ্দুরে চুল শুকোচ্ছে বড় বৌ। উঠোন থেকে সিঁড়ি পর্যন্ত গোবেচারী ভঙ্গীতে হেঁটে গেল সে। এ বাড়ির সকলেই জানে বিশ্বকে পছন্দ করে না বড়বৌ। বিশ্বরা আসার আগে এ বাড়িতে একমাত্র গ্র্যাজুয়েট ছিল বড়বৌয়ের স্বামী।
.চারপাশের বাতাস যেন মাথাটাকে চেপে ধরেছে। ঝাঁকুনি দিল চিনু। ওতে কিছু হবে না। চাপটা আসছে ভেতর থেকে। ভেতর পরিষ্কার করতে হবে। কেমন করে? কোথাও যদি এখন যাওয়া যায়। কোথায়? কলেজে। যে কলেজে কাবেরী পড়ে। ওকে এখন দেখতে ইচ্ছে করছে।
আঁস্তাকুড়ে গুচ্ছেরখানেক পেঁয়াজের খোসা আর শালপাতা। মাংস এসেছে কোন বাড়িতে। চিনু আশ্চর্য হল, আজতো রোববার কিংবা ছুটির দিন নয়! এ পাড়ায় তো ফাল্গুন মাসেও বাঁধাকপির তরকারির গন্ধ পাওয়া যায়!
পুরনো খবরের কাগজ বিক্রি করছে অমূল্যর বৌ। কাগজওলা সের-প্রতি একপো না আধসের সাফাই করবে! অমূল্য থাকলে নিজে হাতে ওজন করে কাগজ বিক্রি করত। সে এখন অফিসে। বৌটার বোধহয় ছেলে হবে। অমূল্যটা ভীষণ কিপটে। কাগজ বিক্রির কথা জানতে পারলে হয়তো বৌকে ধরে ঠ্যাঙাবে। আবার ছেলের ভাতে ছাদে ম্যারাপ বাঁধবে। ব্যাপারটা চিনুর কাছে খুব আশ্চর্যের মনে হল না। অমূল্য বৌকে ভালবাসে। আবার খেটেখুটে পয়সাও রোজগার করতে হয়। রোজগারটা খুব আয়াসে হয় না। পরিবেশের সঙ্গে সংসারের খাপ খাওয়ানোর কথাই আসে। অমূল্য বাইরে ঘোরাফেরা করে। ও বোঝে একটা পয়সা রোজগার করতে কালঘাম ছুটে যায়। পয়সার মর্ম ও বুঝেছে। এই বোঝাটাই ওর কাল হয়েছে। কেননা ঘরের মানুষ তার মত করে ব্যাপারটা বোঝেনি। ফলে যা হবার তাই হয়েছে। ঘর আর বাইরের মধ্যে সামঞ্জস্য রাখতে বৌ ঠ্যাঙাতে হয় অমূল্যকে। ওতে যন্ত্রণা খানিকটা কমে।
অমূল্যর কথা ভেবে চিনুর মনটা নরম হয়। বাড়িতে অনেকগুলো পুষ্যি থাকলেও আবার ছেলে হবে অমূল্যর। হোক। যতদিন মানুষ হন্যে থাকবে, ততদিন জন্মের হার বাড়তেই থাকবে। কষ্ট করে টাকা রোজগার করতে হলেও, রাতে বৌকে পাবার জন্যে তো কষ্ট করতে হয় না। যেখানে কষ্ট নেই সেখানেই তো মানুষ যাবে। অমূল্যও তাই করছে। ওতে কোন দোষ নেই।
কাবেরীর কলেজে ঢুকে প্রথমেই চিনু রুটিনটা দেখল। এখন ক্লাশ নেই কাবেরীর। দোতলায় উঠল। হয়তো কমনরুমে আড্ডা দিচ্ছে। কিন্তু ডাকা যায় কেমন করে। তার থেকেও বড় কথা ডাকার একটা যুক্তিসঙ্গত কারণ দেখাতে হবে। যাচ্ছিলুম এখান দিয়ে, অনেকদিন দেখা হয়নি ভাবলুম একবার দেখা করে যাই। কিন্তু অনেকদিন দেখা হয়নি বলে দেখা করতেই হবে, এমন কোন সম্পর্ক কি তাদের মধ্যে আছে? প্রতিবেশী ভাড়াটে, তার বোন, দিদির কাছে মাঝে মাঝে বেড়াতে আসে। সেই আলাপের জের টেনে কলেজে গিয়ে দেখা করতে হবে, ব্যাপারটা কাবেরীর মনোমত নাও হতে পারে।
চিনু দাঁড়িয়ে পড়ল দোতলার বারান্দায়। ক্লাশে এখনো প্রফেসার আসেনি। কলেজটা মেছোবাজার হয়ে গেছে। মেয়েরা বারান্দায় নিরীহ ছাগল-ছানার মত দাঁড়িয়ে। ছাগল-ছানা শব্দটা মনে মনে বদলে নিল। কিন্তু ছানারা অমন শান্ত হয়ে থাকতে পারে না। মেয়েদের ওপর চোখ বোলাতে গিয়ে চমকে উঠল সে। না, ঠিক কাবেরীর মতই দেখতে গোলাপী শাড়িতে। ও যদি সত্যি সত্যিই কাবেরী হোত। তা হলে নিশ্চয় কাছে এসে জিগ্যেস করত, আপনি যে এখানে? তখন বলতেই হোত, এসেছিলুম একটা দরকারে। কিন্তু মিথ্যে বলতে হবে কেন? যদি সত্যি কথাটাই বলা যায় যে, তোমার জন্যই এসেছি কাবেরী, তোমায় একটু দেখব বলে। তাহলে ও কি বলবে?