বেলা যখর নয়টা তখন থানার বড় দারোগা সাহেব কয়েকজন সি: লইয়া তাহার দোকানে আসিয়া উপস্থিত।
হরিবাবু বড় দারোগার বয়স ষাট বছরের কম হইবে না। তিন বৎসর হইল তিনি ওমেদপুর থানায় আসিয়াছেন। এই দীর্ঘ তিন বৎসরে একদিনের জন্যও রায়হানের সহিত তাহার আলাপ হয় নাই।
পুলিশকে সকলে ঘৃণা ও ভয় করিলেও রায়হান পুলিশর লোক দেখিয়া বিশেষ ভীত হইতেন না,। সুযোগ ও সুবিধা হইলে তিনি তাহাদের সহিত বন্ধুরূপে আলাপ করিতেন। দুঃখের বিষয়, এই ভদ্রলোকের সহিত তাহার কোনো পরিচয় হয় নাই।
থানার বড় দারোগাকে সম্মুখে দেখিয়া রায়হান একটু বিস্মিত না হইয়া পারিলেন না। স্মিত মুখে রায়হান দারোগ বাবুকে সম্মুখস্থ চেয়ারে উপবেশন করিতে অনুরোধ করিলেন।
হরিবাবু অত্যন্ত ভদ্রতার সহিত রায়হানকে নমস্কার করিয়া চেয়ারে উপবেশন করিলেন। রায়হান হাতের কাজ বন্ধ করিয়া দারোগা বাবুর আগমনোদ্দেশ্য জিজ্ঞাসা করিলেন।
দোকানের সম্মুখে দেখিতে শয়তানের মতো কয়জন সিপাই দাঁড়াইয়াছিল। রায়হান তাহাদিগকে আসন গ্রহণ করিতে বলিলেন। বাধা দিয়ে হরিবাবু তাহাদিগকে একটু দূরে সরে যাইতে বলিলেন।
অনেকক্ষণ নিস্তব্ধ থাকিয়া হরিবাবু কহিলেন–“দেখুন, রায়হান সাহেব! আমি আমার সন্দেহভঞ্জন করতে এসেছি। আপনার উপর আমার যথেষ্ট শ্রদ্ধা আছে।”
রায়–আপনি আমার নাম জানলেন কী করে? আমার উপর আপনার শ্রদ্ধার ভাব জেগেছে কেমন করে? আমার প্রশ্নে কোনো রূঢ়তা নাই জানবেন। আপনার সঙ্গে আমার কোনদিন তো পরিচয় হয় নাই।
হরি–আমরা পুলিশের লোক–কোথায় কে কি করে, সে খবর না রাখলে আমাদের কর্তব্য সম্পাদিত হয় না। না থামিয়াই ভাবাবেগে হরিবাবু কহিতে লাগিলেন–পুলিশের লোকেরা কথা কেউ বিশ্বাস করে না–কিন্তু তবুও আমরা একেবারে পশু নহি। বহুলোক ক্ষমতার অপব্যবহার করে। ভদ্রতা রক্ষা না করে ভদ্র ও অভদ্রের উপর তারা তাদের দুরন্ত ব্যবহারের পরিচয় দেয়। আমাকে তা মনে করবেন না। আমি মনুষ্যত্বকে আদর করতে জানি। দেশের মানুষকে আমি ঘৃণা না করে শ্রদ্ধা করি ও ভালবাসি। আমি তাদের বন্ধু হতে ইচ্ছা করি। যে দুরাত্মা সে নিজের আত্মীয়ই হোক আর বিদেশীই হোক তাকে শাস্তি দেওয়া। কর্তব্য। কোনো উত্তরের অপেক্ষা না করিয়া হরিবাবু আবার কহিলেন–চিত্তের স্বাধীনতা নষ্ট না করে আপনি ব্যবসা করছেন ইহা খুব ভালো কথা। একটা নিস্তব্ধ থাকিয়া উৎসাহের সহিত পুনঃ কহিলেন আপনি মানুষের মঙ্গল করতে পারলে পশ্চাৎপদ হন না,এ সংবাদ আমি রাখি। দেশের মানুষকে ভালো করা প্রত্যেক গভর্নমেরন্টের কাজ। আপনি তাই করে থাকেন। চাকরি না করেও সরকার ও আমাদের উদ্দেশ্যকে সার্থক করছেন–বড় ভালো কথা। মানুষের দুঃখ দূর করা, তাদের সুখ ও শান্তির ব্যবস্থা করাই আমাদের কাজ। সর্বত্র ন্যায় ও সত্য প্রতিষ্ঠা করা আমাদের উদ্দেশ্য, আপনারও সেই ব্রত, বড় ভালো–বড় ভালো।
রায়–ক্ষমা করবেন। আপনার অতিরিক্ত প্রশংসায় আমি নিজেকে বিপন্ন মনে করছি। বহু কর্মচারীর সঙ্গে আলাপ হয়েছে। কিন্তু ক্ষমা করবেন আপনার ন্যায় মহানুভব ব্যক্তির সন্ধান কোথায়ও পাই নাই।
হরি-আপনার নিকট কেন এই বেশে এসেছি তার কারণ এখনও বলি নাই। শীঘ্রই গ্রামের সকলকে এখানে ডাকব। কিন্তু তার আগে অপনার মহত্ত্ব ও সত্যপ্রিয়তার উপর নির্ভর করে একটা কথা জিজ্ঞাসা করছি।
রায়–করুন। যা জানি বলবো। তাতে নিজের ক্ষতিই হোক বা আমার আত্মীয় স্বজনের ক্ষতিই হোক গ্রাহ্য করবো না।
হরি–আমার কাছে খবর গিয়েছে আপনি গ্রামস্থ হিন্দু ভদ্রলোকদের অত্যাচার করতে বদ্ধপরিকর হয়েছেন। শ্যামসুন্দর বাবু থানায় এজাহার দিয়েছেন–রাত্রি তিনটার সময় নাকি আপনি বহু লেঠেল নিয়ে তার বাড়িতে পড়ে রমেশকে প্রহার করেছেন। আপনার ইচ্ছা ছিল সমস্ত হিন্দুপল্লী লুট করা। কিন্তু প্রভাত হয়ে যাওয়াতে সে উদ্দেশ্য সিদ্ধ হয় নাই। আপনি কিছু মনে করবেন না। আপনার উপর আমার যথেষ্ট শ্রদ্ধা থাকলেও আইন মেনে আমাদিগকে কাজ করতে হয়। বলুন এখন আপনার উত্তর।
রয়হান একেবারে স্তম্ভিত হইয়া গেলেন। তার বিরুদ্ধে এমন অভিযোগ! যে হিন্দু প্রীতির জন্য রায়হানকে অনেক সময়-অনেক সহধর্মীর কাছে উপহাস লাভ করিতে হইয়াছে, তার ফল এই! এক দেশে বাস করিয়া সে কখনও কোনো কাজে হিন্দুকে বাদ দিতে চায় নাই। বিশেষ করিয়া শ্যামসুন্দর কেমন করিয়া তার বিরুদ্ধে এমন অভিযোগ আনয়ন করিলেন! সে যে তার কাকা। চিরকালই সে তাকে কত শ্রদ্ধায় কাকা বলিয়া ডাকিয়া আসিয়াছে। তার মেয়ে গিরিবালাকে রায়হান কত স্নেহের চোখে দেখে। তবে কি হিন্দু-প্রীতির কোনো মূল্য নাই? তাহার সহধর্মীরা যেমন বলিয়া থাকেন হিন্দুর ভালবাসা শুধু মুখে। মুসলমানকে তাহারা কখনও ভালবাসে না। এসব অভিযোগ কি সত্য?
রায়হান অত্যন্ত বিস্ময়ে কহিলেন–“আমি রাত্রে তিনটার অনেক আগে খোরশেদকে নিয়ে স্টেশনে গিয়েছিলাম।”
“বাস, আর কিছু দরকার নেই”–বলিয়া দারোগা বাবু সিপাই হরিসিংকে ডাক দিলেন।
হরি সিং লগুড়হস্তে উপস্থিত হইয়া ভাবিল রায়হানকে বুঝি বাঁধিবার হুকুম দেওয়া হইবে। সে একবার তাহার রক্ত চক্ষু শোণিত পিপাসু শার্দুলের ন্যায় রায়হানের উপর নিক্ষেপ করিল। কিন্তু দারোগা বাবু হুকুম দিলেন”গ্রামের সকল ভদ্রলোককে এখানে ডেকে আন। কোনো অভদ্রতার পরিচয় দিস না যেন।” হরিসিং সেলাম করিয়া প্রস্থান করিল।