আবদুল করিমের সাংসারিক অবস্থা কিছু দিন হইতে ভালো হইয়া উঠিয়াছে। তার ইচ্ছা একবার সে মক্কাশরীফে ও বায়তুল মোকাদ্দসে যায়। ফকির-দরবেশকে সে খুবই ভক্তি করে।
রাস্তার ধার দিয়া রমেশ যাইতেছিল। তাহার বিপরীত পার্শ্ব দিয়া আবদুল করিমও সেতাবদ্দীন পশ্চাৎ হইয়া আসিতেছিল।
দিনের আলোর মতো জোছনায় আবদুল করিম চোখ তুলিয়া দেখিল একজন মুসলমান দরবেশ আপন মনে চলিয়া যাইতেছেন হাতে তসবীহ।
আবদুল আকস্মাৎ ভক্তিপ্রাণ হৃদয়ে সেতাবদ্দীনকে অপেক্ষা করিতে বলিয়া ছদ্মবেশী
রমেশের সম্মুখে যাইয়া উপস্থিত হইল। দেখিল, সত্যই তিনি একজন দরবেশ। সে
তাড়াতাড়ি রমেশের পদধূলি লইয়া ভক্তি বচনে কহিল, “হুজুর, আপনাকে দেখে নিজকে ধন্য মনে করছি। আমার নসীব আজ বড়ই বুলন্দ।”
অতঃপর সেতাবদ্দীন আসিয়া রমেশের পদচুম্বন করিল।
রমেশ কথা কহিতে পারিতেছিল না।–কৃষ্ণ! একি বিপদ?–মা কালী, দুর্গে! যে ভক্তিলাভ করিবার জন্য মানুষ কত যুগ ধরিয়া সাধনা করে, আজ এই সঙ্কটময় মুহূর্তে সেই ভক্তি লাভ করিয়া রমেশ বড়ই বিপন্ন।
আবদুল কহিল–”হুজুর,দয়া করিয়া আমার গৃহে পদার্পণ করুন। বান্দা আপনার চরণ পূজা করতে পারলে নিজকে অত্যন্ত ভাগ্যবান মনে করবে। হুজুর কোথা হতে আসছেন?”
রমেশ কি কহিবে অথচ একটা উত্তর না দিলেও নয়। সে কহিল, ‘বিসমিল্লা-বোমানা রিম-কাল্লা সালে আলেকুম।”
বিস্ময়ে নির্বাক হইয়া আবদুল রমেশের শ্বেত শুশ্রুশোভিত মুখের দিকে চাহিয়া রহিল। এ যে তার বিশ্বাস ও ভক্তির প্রতি একটা ভায়ানক পরিহাস গোছের হইয়া চলিল। সংশয়ে আবদুল জিজ্ঞাসা করিল–“আপনি কোথা হইতে আসছেন?”
রমেশ শক্তির সহিত তসবী টিপিয়া বলিল–“সুবান আল্লা-সুবান আল্লা। আমি দরবেশ-মোক্কা হইতে আসছি। বিসমুল্লা আলেকুম।”
লোকটি কি পাগল! তাই হবে–কিন্তু পাগল হলেও সে আরবি কথা এত ভুল ও বিকৃত করিয়া উচ্চারণ করিবে কেন? পাগল কি গতজীবনে এত সহজ জানা কথাগুলিও বিকৃত করিয়া বলে?
আবদুল বিরক্ত হইয়া কহিল–“দরবেশ বলিয়া কোনো কথা নাই।”
রমেশ ক্রোধে অধীর হইয়া কম্পিত স্বরে বলিল–নেড়ে, কাফের।
ভক্তির বিনিময়ে কিছুই লাভ না করিয়া আবদুলের মনটা কেমন হইয়া উঠিয়াছিল। তাহার উপর নেড়ে উপাধি লাভ করিয়া সে যুগপৎ বিস্মিত ও স্তম্ভিত হইয়া কহিল–“আপনি কোথাকার ভণ্ড! মুসলমান হয়ে মুসলমানকে নেড়ে বলেন! আপনি মুসলমান নন। আমার সন্দেহ হচ্ছে। এর মধ্যে খুব রহস্য আছে।”
রমেশ –বটে, আমি মুসলমান নই! আমি দরবেশ, মোক্কা শরীফ হইতে আসিয়াছি। পথ ছাড়িয়া দাও। সুবান আল্লা।
আবদুল –আপনি নিশ্বয়ই মুসলমান নন। আমার খুব সন্দেহ হচ্ছে দরবেশ, কথাটি মোক্কা শরীফ হতে আসে না। আসে মক্কাশরীফ হতে। আচ্ছা, বলুন তো, মুসলমানের ধর্মে বিশ্বাস কি? কলেমাগুলি পাঠ করুন দেখি।
বেগতিক দেখিয়া রমেশ থতমত খাইয়া গেল। অনেকক্ষণ হইতে সে প্রবল চেষ্টায় মনের বল ঠিক রাখিয়াছিল। এখন তাহার কণ্ঠ শুকাইয়া উঠিল। আর উপায় নাই।
অত্যন্ত ক্ষিপ্রতার সহিত রমেশ দৌড়াইয়া রাস্তার পার্শ্বে আম্রকাননের মধ্যে ঢুকিয়া পড়িল। পলায়মান রমেশের পশ্চাৎ পশ্চাৎ আবদুলও ছুটিল।
সেতাবদ্দীন দাঁড়াইয়া রহিল না।
কিছুদূর দৌড়াইয়া তাহারা রমেশের গলা ধরিয়া ফেলিল। কিন্তু একি? হস্তের আকর্ষণে লোকটির মাথার উপর হইতে কি খসিয়া আসিল! চাঁদের আলোকে সরিয়া আসিয়া আবদুল দেখিল সেটা একটা পরচুলা। কী বিস্ময়!
ঘাড় ধরিয়া দুই একটা নাড়া দিতেই রমেশের শুশ্রু খসিয়া পড়িল। ওমা, এ যে বলাই ঘোষের পুত রমেশ!
অবদুল ও সেতাব রমেশকে খুব করিয়া আপমানসূচক গালি দিল, তা ছাড়া ভয়ানক প্রহারও করিল। আরও কহিল–হিন্দুদের এত বড় স্পর্ধা! মুসলমানের ধর্ম লইয়া এত বড় তামাসা! দরবেশ-ফকির কি ঠাট্টার জিনিস? শুধু রমেশকে নয়, সমস্ত হিন্দুকে এবার জব্দ করবো। ক্রোধে আবদুলের কণ্ঠস্বর রোধ হইয়া আসিতেছিল।
তাহার পর তাহারা রাস্তা ধরিয়া মুসলমান পাড়ার দিকে চলিয়া গেল। রমেশ অত্যন্ত যাতনায় রাস্তার ধারে পড়িয়া রহিল।
রায়হান যখন মিলাদ পাঠ করিতেছিলেন খোরশেদদের বাড়ির পাশে কচুবনের ভিতর দুইটি হিন্দু যুবক নিঃশব্দে বসিয়াছিল। মশা তাহাদিগেকে অত্যন্ত উতলা করিতেছিল। কিন্তু তবুও তাহারা স্থির ও উৎকর্ণ হইয়া অপেক্ষা করিতেছিল।
আহার-শেষে মেয়েরা কথা কহিয়া বাড়ির পথে যখন অগ্রসর হইবার উদ্যোগ করিতেছিলেন তখন হরিদয়াল ও ভজহরি উধ্বশ্বাসে হাঁপাইতে হাঁপাইতে দৌড়াইয়া শ্যামসুন্দরের বাড়িতে আসিয়া মূৰ্ছিত হইয়া পড়িল।
চোখে-মুখে জলের ঝাঁপটা দিয়া সকলে যুবকদ্বয়ের চৈতন্য সম্পাদন করিলেন। তখন একটু প্রকৃতিস্থ হইয়া হরিদয়াল কহিল–“আর রক্ষা নাই। বহু লাঠিয়াল খোরশেদদের বাড়িতে সমবেত হয়েছে। কানে শুনলাম, আজই রাত্রে তারা হিন্দুপল্লী আক্রমণ করিবে। তাদিগকে বাহির হতে দেখে এসেছি।”
আর কথা নাই–মুহূর্তমাত্র বিলম্ব না করিয়া সমস্ত হিন্দু যে যেমন করিয়া পারিল গ্রাম ছাড়িয়া পলায়ন করিল। থাকিল কেবলমাত্র কয়েকজন পুরুষ।
.
সপ্তম পরিচ্ছেদ
স্টেশন হইতে রায়হান যখন ফিরিয়া আসিলেন তখন ফরসা হইয়া গিয়াছে। বিশ্রামের সময় ছিল না। অতঃপর নামাজ পড়িয়া সেলাইয়ের কল লইয়া একটা জামা সেলাই করিলেন।