রসনা তখন সকলেই সরস হইয়া উঠিয়াছিল। সরম ও লজ্জায় করিমা ও বালিকা আমেনা বাকি দুইজনের স্থান গ্রহণ করিলেন।
কোনো কারণে আকস্মাৎ হামিদের ললাট স্বেদসিক্ত হইয়া উঠিল। জিহ্বা তাহার শুষ্ক হইয়া গেল। তাহার সহযোগী ঐ সুন্দর হাস্যময়ী লীলামধুর বালিকাটির পানে তাহার ঘৃণিত চিত্ত এমনভাবে লুটাইয়া পড়িতেছে কেন? সহসা নীরবে সে আল্লার নাম লইয়া ভাবিল তাহার চিত্তের এই ভাবপ্রবণতা কি খোদার কাছে ঘৃণিত?–তা বোধ হয় নয়। হউক তাহার চিত্ত এত উন্মনা তাতে কি ক্ষতি?–এটা সম্মান ও শ্রদ্ধা ছাড়া আর কী?
মিলাদ ও তাহার অন্তে রায়হানের বাড়ি যাওয়া হইল না। জমাজমি সংক্রান্ত কোনো কাজে খোরশেদকে সেদিন টাউনে যাইতে হইবে। হামিদকে সঙ্গে লইয়া তাহারা খোরশেদের সহিত শেষ রাত্রিতে গাড়ির জন্য স্টেশনে যাত্রা করিল।
০৬-১০. হিন্দু পাড়ায় শ্যামসুন্দরের বাড়িতে
ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ
হিন্দু পাড়ায় শ্যামসুন্দরের বাড়িতে দুপুররাত্রে পাড়ার সব হিন্দু সমবেত হয়েছেন–পুরুষ নারী উভয়েই। আজ কয়েকদিন হইতে রোজই তারা এমন করেন।
নগেন ঘোষ বলিল–“যাই বল, এবার যে গ্রামে থাকতে পারবো এরূপ মনে হয় না। যে গুজব শুনে আসছি তা একেবারে ভিত্তিশূন্যতা বোধ হয় না। জালালপুরে যে ব্যাপার হয়ে গিয়েছে তার খবর তো সকলেই রাখ। এই আগুন বঙ্গের সর্বত্র ছড়িয়ে পড়বে। মোসলমানেরা একেবারে ক্ষেপে গিয়েছে। তারা আর আমাদিগকে রাখবে না। এই বেলা পালিয়ে স্ত্রী-কন্যার সম্মান রক্ষা করা চাই। নইলে কী যে বিপদ হবে তা ঠিক করে বোঝা যাচ্ছে না। আর দেরি করা নয়। সেদিন খোরশেদ যে গিরিবালাকে মেরেছে এটা সামান্য কথা মনে করো না। এর সঙ্গে আরও অনেক কিছু জাত আছে। ওরা সহজে ছাড়বে বলে মনে করো না।এই সামান্য ঘটনা হতে বুঝতে পার তাদের জেদ ও দেমাক কত বেড়ে গিয়েছে। যার যার মতো সরে পড়ো।”
গিরিবালার বাবা শ্যামনসুন্দর বলিলেন–“মেয়েকে মেরেছে তাতে দোষ নাই। এরপর আরও যদি কিছু হয় তা হলে জাত থাকবে না। নতুন গুজবের সত্য-মিথ্যা আমাদের গুপ্তচরদের দ্বারা দেখা যাউক কিছু জানা যায় কিনা। খোরশেদের বাড়িতে একশ লেঠেল এসে লুটের জন্য প্রস্তুত হচ্ছে, এইটিই হচ্ছে বড় কথা। ভাই, এতদিনের পর স্ত্রী কন্যাকে হারাতে হল।’ এই বলিয়া শ্যামসুন্দর অশ্রু বিসর্জন করিতে লাগিলেন।
প্রায় পঞ্চাশজন স্ত্রীলোকে সেখানে বসিয়াছিলেন; তারাও অশ্রু বিসর্জন করিতে লাগিলেন।
নগেন ঘোষ বলিলেন–“চুপ চুপ, আস্তে। হরিদয়াল আর ভজহরি ফিরে এলেই বোঝা যাবে আজকার নতুন গুজবের অর্থ কী। সত্য-মিথ্যা টের পাওয়া যাবে। কিন্তু বড় দেরি হয়ে যাচ্ছে। আমি বলি, রমেশও যাক।”
রমেশ বলিল–“কোনোও রকমে তারা যদি বুঝতে পারে, আমি গোয়েন্দাগিরি করতে গিয়েছি, তা হলে তারা আমায় আস্ত কেটে ফেলবে। তবুও আপনারা যদি বলেন, সকলের মঙ্গলের জন্য আমি প্রাণ দিতে রাজি আছি। কিন্তু এই বেশে আমি যেতে পারবো না।”
রমেশের মা বলিলেন–“বাবা আমাদিগকে রক্ষা করো। তুই ফকিরের বেশ নিয়ে যা।” সকলেই রমেশের মার বুদ্ধির প্রশংসা করিল।
তারপর সকলে মিলিয় রমেশের মাথায় একটা পাগড়ি পরাইয়া দিল। গ্রামের সখের যাত্রার দল ছিল–তাহাদের সাহায্যে বৃদ্ধ ফকিরের কৃত্রিম শুষ্ক শ্মশ্রু সংগ্রহ করিতে বিশেষ বেগ পাইতে হইল না।
রমেশ মুসলমান ফকির সাজিয়া আল্লাহর নাম না লইয়া হিন্দু মতোই মনে মনে কৃষ্ণ নাম উচ্চারণ করিতে লাগিল। কালবিলম্ব না করিয়া সেই বেশে মিত্রদের পুকুরপাড় দিয়ে সে রাস্তায় আসিয়া উপস্থিত হইল। জোছনার আলোক বলিয়া সে একাকী এই দুঃসাহসিক কর্মে লিপ্ত হইবার সাহস সংগ্রহ করিয়াছিল।
ভয় যে তাহার মোটেই হইয়াছিল না তাহা বলিতে পারি না। মনে মনে সে পুনঃ পুনঃ হিন্দু দেবতার নাম লইতেছিল। ভয়, পাছে তাহার চতুরী ধরা পড়ে।
হিন্দুপাড়ায় গুজব উঠিয়াছিল, মুসলমানেরা বহু লাটিয়াল লইয়া হিন্দুদের বাড়ি-ঘর লুঠ করিবে। তাহাদের স্ত্রী-কন্যার সম্মান নষ্ট করা হইবে। ফলে হিন্দু পাড়ার ভদ্র-অভদ্র, যুবক যুবতী, প্রৌঢ়পুরুষ-রমণী এবং বৃদ্ধদের দারুণ আশঙ্কা উপস্থিত হইয়াছিল। এরই গুজবের মূল, ভিন্নদেশে হিন্দু মুসলমানদের মধ্যে দাঙ্গা।
গিরিবালার বাবা শ্যামসুন্দরের বাড়িতে সমস্ত হিন্দু সমবেত হইয়াছিল। তাহাদের ধারণা কোনো সময়ে মোসলামানেরা আসিয়া তাদের উপর পড়ে তাহার কোনো ঠিকানা নাই। সঠিক সংবাদ জানিবার জন্য রোজই যেমন পাঠান হয় আজও তেমনি গুপ্তচররূপে দুইজন যুবককে মোসলমান পাড়ার অবস্থা জানিবার জন্য পাঠান হইয়াছিল। তাহাদের বিলম্ব হইতেছে দেখিয়া সকলে রমেশকে ছদ্মবেশে পাঠাইলেন। হরদয়াল ও ভজহরি কীভাবে গিয়াছিল তাহা আমরা জানি না। আজ তাহারা একটা নূতন গুজব শুনিয়া বেশি রকম আশঙ্কিত হইয়া পড়িয়াছেন। রমেশ যদি অত ভীত না হইয়া একটু মনের বল সংগ্রহ করিয়া লইত তাহা হইলে তাহার ভাগ্যে এমন দুর্ঘটনা ঘটিত না। এই ভীতিই হইয়াছিল তাহার শত্রু।
রমেশ দেখিল, দূর হইতে দুইজন মুসলমান কৃষক তাহার দিকে আসিতেছে। সে তখন হিন্দুপাড়া ছাড়িয়া একেবারে মুসলমান পাড়ার মধ্যে আসিয়া পড়িয়াছে।
আবদুল করিম এব সেতাবুদ্দীন বন্ধু হেলালের বাড়ি হইতে দাওয়াত খাইয়া গৃহে ফিরিতেছিল। কৃষক হইলেও তাহাদের যথেষ্ট ধর্মভাব বিদ্যমান ছিল এবং ধর্মবিষয়ক অনেক কথাও তাহারা জানিত।