রায়হান বলিলেন–“আমাদের মা-বোন ছাড়া তো অপর কেউ নাই।” হামিদ অন্য দিকে মুখ ফিরাইয়া কহিল–“যদি কোনো বাজে লোক এসে পড়ে?” রায়হান বলিলেন–“না, ভিতরে আর কেউ আসবে না।”
মেয়েরা ভক্তিপ্রবণ হৃদয়ে অর্ধ আলো-আঁধারে ফুরাসের উপর বসিয়া গেলেন। তাঁহাদের সম্মুখে একাট মসৃণ ছোট গালিচার উপর বসিয়া রায়হান মহানবীর জীবনী পাঠ আরম্ভ করিলেন।
বামপার্শ্বে একটা উজ্জ্বল আলোক। তাকিয়ার উপর পুস্তক রাখিয়া চক্ষু মুদ্রিত করিয়া রায়হান একটা আরবি গান গাহিলেন–
“চিন্ময় ওগো, মধু আর প্রেম!
প্রেম-বর্তিকা জ্বাললিয়া দাও।।
রক্ত-লোহিত আত্মার মাঝে
একবার আসি গাহিয়া যাও।
বেদনা-বিধুর মানুষের মনে,
ওগো গেয়ে যাও তুমি গান।।
ভাবুক হৃদয়ে শুষ্ক তাপিত,
প্রভো, তোমার প্রেমের বান;
ওগো, বজ-আঘাতে চূর্ণ হউক,
প্রভো, কালিমা মোদের চিত্তে।।
ফুলে ফুলে হোক গন্ধের মেলা।
প্রভো, তোমার মহিমা বিত্তে।”
গান থামিল। শ্রোতাদের আত্মার শিরায় শিরায় একটা পবিত্র ভাবের ধারা বহিয়া গেল। জগতের সহিত যেন কাহারও কোনো সম্বন্ধ রহিল না। অহঙ্কার ও নীচতা আত্মা হইতে যেন মুহূর্তের জন্য ধুইয়া পুছিয়া গেল।
দূরে এক প্রান্তে করিমা ও আমেনা এ উহার গায়ে হাত দিয়ে বসিয়াছিলেন। দৃষ্টি তাঁহাদের রায়হানের গম্ভীর ভাবময় ললাটের উপর নিবদ্ধ। পলকহীন দৃষ্টি, স্থির চৈতন্য নিথর বপু। এই সামান্য কয়েক মুহূর্তে তাহাদের কাছে মনে হইতেছিল এক যুগ। শত বৎসরের ভিতর দিয়া তাহারা আজ যেন সহসা এক আলোক ও শুদ্ধতার সম্মুখে আসিয়া দাঁড়াইয়াছে।
রায়হান বলিলেন–আমাদের যেদি ধর্ম সেটি নূতন নহে। যারা বোঝে না তারাই বলে এটা হজরত মোহাম্মদের ধর্ম। ঈশ্বর এক–তিনি মহান-পাপ ও অজ্ঞানতার বিরুদ্ধে মানুষকে দাঁড়াতে হবে–এই চিরন্তন সত্য যুগে যুগে মহাপুরুষেরা প্রচার করেছেন। এইসব মহাপুরুষ, একটা বিরাট বেদনা ও সহানুভূতির দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়েছেন। মহামানুষ মোহাম্মদ এই মহাপুরুষদের অন্যতম। তিনি সত্যের সংস্কারক মাত্র। ইসলাম নূতন নহে। যাহা সত্য তাহা নূতন নহে–সত্য ছিল, আছে ও থাকবে।
এই মহামানুষ পৃথিবীতে এসেছিলেন মূর্খতা, অন্ধতা ও পাপ হতে মানুষকে রক্ষা করতে। মানুষের দুঃখ তাহার অন্তরকে বাল্যকালেই ভাবপ্রবণ করে তুলেছিল। মানুষের পাপও দুঃখের কারণ মূর্খতা অন্ধতা। এই মূর্খতা ও অন্ধতা দূর করা ইসলামের শ্রেষ্ঠ নির্দেশ। জ্ঞানের সাধনা উপাসনা সমতুল্য। মুখ সহস্র বৎসর উপাসনারত থাকলেও বিশেষ পূণ্য অর্জন করিতে পারে না। অর্থ না বুঝে ভাব-গদগদচিত্তে পবিত্র কোরান মজিদ পাঠ করলেও পূণ্য লাভ হয় না, কোরান পাঠ করতে পারলেই জ্ঞান লাভ হয় না। কোরানের অর্থ বোধ হওয়া চাই এবং সে অর্থ গ্রহণ করার জন্য বিপুল জ্ঞান লাভ আবশ্যক।
বাহুর শক্তি অপেক্ষা, মনের দৃষ্টির মূল্য বেশি। যে পাপ করে এবং নীচতা,লোভ ও বাচালতার দ্বারা আত্মাকে কলঙ্কিত করে সে এই দৃষ্টি লাভ করতে পারে না।
ইসলামে নারীর সম্মান খুব বেশি। নারীকে যে অপমান করে সে পাপী। নারীর শক্তি জাগিয়ে তোলা আবশ্যক। পারাধীনতায় মানুষ পশু হয়। নারীকে স্বাধীনতা না দিলে তাহার মনের নীচতা ও সঙ্কীর্ণতা ঘুচবে না। পুরুষ অপেক্ষা নারীর শিক্ষা বেশি দরকার। শিক্ষিতা নারীর জ্ঞান ও চরিত্রশক্তি জাতিকে অতি অল্প সময়ে শক্তি ও আত্মমর্যদা জ্ঞানসম্পন্ন করে তুলতে পারে।
সমস্ত বিশ্ব হতে নারীকে সারাজীবন এক কারাগারে আবদ্ধ করে রাখবার পুরুষের কী অধিকার আছে। পাপের ভয়ে?–নারী কি নিজের মর্যাদা নিজে বুঝে না? সে কি নিজেকে নিজে রক্ষা করবার চেষ্টা করতে পারে না? সে নিজেকে নিজে প্রতিষ্ঠিত করবার অধিকারী হতে জানে না?
আমাদের মহানবী এসেছিলেন মানুষকে পাপ হতে রক্ষা করতে। যে মানুষ আত্মাকে শুদ্ধ ও পবিত্র করবার চেষ্ট না করে ধর্মকার্যে লিপ্ত হয় সে ভণ্ড। প্রতিদিন পাঁচবার উপাসনা করবার মতো প্রত্যেক মুসলমানকে জ্ঞানলাভের জন্য সর্বদা সজাগ থাকতে হবে। মূখের। উপাসনার কোনো মূল্য নাই।
ফুলের মতো নিজেকে পবিত্র করবার জন্য চেষ্টা করতে হবে। যে তাহা করে না, এবং শুধু এবাদতের দ্বারা স্বর্গে যাবার ইচ্ছা পোষণ করে, সে ভুল করে।
প্রায় দুই ঘণ্টা ধরিয়া হজরতের জীবন-মহিমা ও বিশেষত্ব সম্বন্ধে বক্তৃতা হইল। অতঃপর উপস্থিত শ্রোতৃবর্গের উপর এলাহীর করুণা ভিক্ষা করিয়া সকলে মোনাজাত করিলেন। তারপর সভা ভঙ্গ হইল। –প্রায় পঞ্চাশজন নারী সমবেত হইয়াছিলেন। প্রত্যেকেই ইচ্ছাপূর্বক চারি আনা করিয়া চাঁদা দিয়াছিলেন। পুরুষ ভদ্রলোকেরাও মেয়েদের স্বাধীনভাবে কথা বলাবলি করিবার সুযোগ দিবার জন্য চাঁদা দিয়াছিলেন। একুনে পঁচিশ টাকা চাঁদা সংগৃহীত হইয়াছিল। এই পঁচিশ টাকা দিয়া পোলাও, গোস্ত ও দধির ব্যবস্থা হইয়াছিল।
মিলাদ অন্তে নফিসা খাতুনের উপদেশ মতো সকলে সারি সারি বসিয়া গেলেন। বৃথা ঝঞ্ঝাট বাড়ানো হইবে ভয়ে মেয়েরা আগেই কিছু পয়সা খরচ করিয়া কলা ও পদ্মের পাতা এবং সোরাই ক্রয় করিয়া আনিয়াছিলেন। শীতল জলে ভর্তি করিয়া সোরাইগুলি মাঝে মাঝে রাখিয়া দেওয়া হইল।
প্রত্যেক পঙক্তিতে বারজন করিয়া বসিলেন। সুতরাং অন্তত চারিজন খাদেম আবশ্যক। রায়হান ও হামিদের উপর পরিবেশন ভার পড়িল। কিন্তু তবুও আরও দুইজন বাকি।