খোরশেদ কটমট করিয়া হামিদের দিকে চাহিয়া কহিল–“তুমি একটা গরু!”
কয়েক মুহূর্ত নির্বাক থাকিয়া, বই গুছাইয়া আবার তাহারা বাড়ির দিকে চলিল।
হামিদ প্রহৃত সহপাঠীকে সান্ত্বনা দিতেছিল।
খোরশেদ ক্ষুদ্ধ অপমানের বেদনা লইয়া আগে চলিল। এই সময় একটা হিন্দু-মেয়ে পুকুর হইতে কলসি কাঁখে লইয়া পার্শ্বের পথ হইতে খোরশেদের সম্মুখে আসিল। দুটি পথ যেখানে মিলিত হইয়াছে সেটা পুকুরের দক্ষিণ-পশ্চিম কোণা। খোরশেদের গায়ের সঙ্গে কলসির স্পর্শ ঠিক লাগে নাই।
টুপি-পরা খোরশেদকে লক্ষ্য করিয়া বালিকা কহিল–“রাম! মুসলমান ছোঁড়াদের জ্বালায় আর এ-পথ দিয়ে জল নেওয়ার যো নাই।”
একে খোরশেদের মনে তখনও অপমানের রক্ত ক্ষরিত হইতেছিল, তাহার উপর এই দ্বিতীয় আঘাতে সে নিতান্তই ধৈর্যশূন্য হইয়া পড়িল, কহিল–“তুই শ্যামসুন্দরের মেয়ে। ন? মুসলমান ছোঁড়ারা কী এই পথ দিয়ে নূতন গেল! মুসলমানের গায়ে কি গন্ধ! হারামজাদি!”
গিরিবালা কহিল–“কি! ভদ্রলোকের মেয়ের সঙ্গে মুসলামনের ছেলের এত হাইয়ের কথা! ছোটলোক, দূর হ।” এই কথা বলিতে বলিতে গিরিবালা তাহার কলসির জল ঢালিয়া ফেলিল।
খোরশেদ অত্যন্ত অপ্রস্তুত হইয়া প্রচণ্ডবেগে গিরিবালার ঘাড় ধরিল। বাম পা দিয়া একটা ভয়ানক পদাঘাতে পিতলের কলসিটাকে পুকুরের মধ্যে ফেরিয়া দিল। তারপর তাহার চুল ধরিয়া খোরশেদ বালিকার পিঠের উপর মুহুর্মুহু আঘাত করিতে লাগিল।
খোরশেদের চক্ষু দিয়া আগুন বাহির হইতেছিল। এই কাণ্ড অতি অল্প সময়ের মধ্যে ঘটিয়া গেল।
হামিদ দৌড়াইয়া আসিয়া খোরশেদের হাত ধরিয়া কহিল–“খোরশেদ, তুমি পাগল হলে? আজ কি তোমায় ভূতে ধরেছে? সেয়ানা মেয়ের গায়ে হাত দাও! এটা তোমার কি অভদ্রতা নয়!”
খোরশেদ ক্রোধে কহিল–“বটে! আমায় ভুতে ধরেছে? তা ঠিক। কাল ওকে উলঙ্গ হয়ে পথের ধারে বেড়াতে দেখলাম। মেয়েছেলে কি না, সেয়ানা হয়ে ভারি বাহাদুর হয়েছে। ও আমাকে মুচি মোসলমান বলতে একটু দ্বিধা বোধ করলে না। কাফেরের বংশকে পাথর দিয়ে মেরে ফেলা উচিত।”
হামিদ শান্তস্বরে অথচ বিরক্ত হইয়া কহিল–“একই কথা বারে বারে বলা যায় না। ওদের যা আচার পুরুষানুক্রমে চলে এসেছে সেটা ওরা কী করে ভুলবে! যে তাতে রাগে সেই পাগল। তুমি একটু দূর দিয়ে গেলেই পাত্তে। এক হিন্দু অন্য হিন্দুকে ঘৃণা করে তা জান। স্বামী বৌকে ঘৃণা করে। পিতা পুত্রকে ঘৃণা করে। পুরোহিত শিষ্যকে ঘৃণা করে। এক দেশের হিন্দু অন্য দেশের হিন্দুকে ঘৃণা করে। মুসলমান তো দুরের কথা। ঘৃণার দ্বারাই ওরা ওদের স্বতন্ত্র রক্ষা করে আসছে। ওতে যে রাগে সে পাগল।”
পুকুর ঘাটের মেয়েরা তখন কথা বন্ধ করিয়া দিয়াছিল। তাহাদের হাসি তখন থামিয়া গিয়াছিল। বিলম্ব না করিয়া ভয়ে ভয়ে মেয়েরা যার যার মতো বাড়ি ফিরিয়া যাইতে লাগিল।
হামিদ রমেশকে কানে কানে বলিল–“খোরশেদ বুঝি আজ নেশা করেছে। মাঝে মাঝে তার মাথা খারাপ হয়। তুমি এই মেয়েটিকে নিয়ে ওদের বাড়ি পৌঁছে দিয়ে এস; আমি ওকে নিয়ে বাড়ি যাই।”
.
পঞ্চম পরিচ্ছেদ
ওমেদপুরে মৌলবীরা অনেকবার মিলাদ শরিফ পাঠ করিয়াছেন। কিন্তু কেহই তাহার একবর্ণও বুঝিতে পারে নাই। কেবল উর্দু, ফারসি ও আরবি, শ্রোতাদের হৃদয় তাতে কাঁদে নাই–ভক্তি ও রসে মন কাহারো আপুত হয় নাই।
পাড়ার বৌ-ঝি আর মুরব্বী মেয়েদের অনুরোধে রায়হান বাংলা-ভাষায় মিলাদ পাঠ করিবেন। এই কার্যে নফিসা ছিলেন প্রধান উদ্যোগী। সুতারাং তাহারই বাড়িতে উৎসবের ব্যবস্থা হইয়াছে।
জোছনালোকে-স্নাত গ্রামখানি সিগ্ধ সৌন্দর্যে ভরপুর। আলো-বাতাসে মহিমা খেলিয়া বেড়াইতেছিল। মৃদু স্নিগ্ধ সমীর ধীরে বহিতেছিল। শ্যাম গ্রাম্য ছবিখানি শুভ্র বসনে কাহার দিকে যেন তাকাইয়াছিল।
সুন্দরীরা গ্রাম্য নির্জন পথ দিয়া ধীরে ধীরে খোরশেদের বাড়িতে আসিয়া সমবেত হইলেন।
ভাইকে লইয়া কর্মীরাও আসিয়াছিলেন। একখানা ধধবে সাদা কাপড় পরিয়া আভরণহীনা করিমা অন্তঃপুরে নফিসাকে যাইয়া সালাম করিলেন।
রায়হান একখানা পাটির উপর ঘরের বারান্দায় বসিয়াছিলেন। গ্রামের কোনো মেয়ে বা বধূ তাহাকে দেখিয়া লজ্জা বোধ করেন না। সকলেই তার আপনার।
হামিদ রায়হানের পার্শ্বে যাইয়া উপবেশন করিলেন।
পুরুষের ভিতর কেবল হামিদ, রায়হান ও খোরশেদ আজিকার এই উৎসবে যোগদানের অধিকারী হইয়াছিল।
রায়হানের পার্শ্বে রেড়ীর তেলের একটা প্রদীপ জ্বলিতেছিল। আর কোথাও কোনো প্রদীপ ছিল না। উঠানের উপর মেয়েরাই প্রশস্ত ফরাস পাতিলেন। ওজু করিয়া তাঁহারা এক এক স্থানে উপবেশন করিতে লাগিলেন।
পূর্বপার্শ্বে ফুলগাছের আড়ালে জোছনালোকে জোছনার মতোই ফুটফুটে মেয়েটি কে?–হামিদ নিরীক্ষণ করিয়া দেখিলেন–সে আমেনা।
আমেনা এত সুন্দর তা তো হামিদ আগে লক্ষ্য করে নাই? একটা অস্ফুট মৃদু শব্দ হামিদের ওষ্ঠদ্বয় কাঁপাইয়া গেল। তাহার শিরায় শিরায়, তাহার অন্তরের গোপন ঘরে একটা নবীনতার মধুময় ঝিলিক ছুঁইয়া গেল। কিন্তু তৌবা একি? নিঃশব্দে বসিয়া হামিদ রায়হানকে জিজ্ঞাসা করিল–“আর দেরি কি ভাই? আরম্ভ করে দিন।” তাহার পর তাড়াতাড়ি আবার সে জিজ্ঞাসা করিল–“আমাদের আর ওঁদের ভিতরে একটা পরদা হলে ভালো হত না?