দুপুর বেলায় উৎসব-অবসাদে বৈকালে বাড়িখানি নিস্তব্ধ হইয়া গিয়াছিল। রায়হান একটা মোটা জোলার তৈরি চাঁদর গায়ে দিয়া খালি পায়ে একাকী রাস্তা ধরিয়া চলিলেন। একটা কঠিন দুর্জয় মানসিক তেজ তাহার মুখখানাকে থাকিয়া থাকিযা শক্ত করিয়া তুলিতেছিল।খানিক পথ চলিয়া রায়হান একবার মাঠের দিকে চাহিলেন। অস্পষ্ট দৃঢ়কণ্ঠে রায়হান দূর দিগন্ত পানে দৃষ্টি নিক্ষেপ করিয়া কহিলেন–“জীবনকে মিথ্যা করিতে পারি না। পিতার জীবনের একটা অলীক খেয়ালকে না মানিলে যদি তিনি ব্যথিত হন তা হলে কোনো উপায় নাই। আমি আমার পিতাকে সত্যরূপেই গ্রহণ করিতে চাই।”
ক্রমে সন্ধ্যা ঘনাইয়া আসিল। রায়হান রাস্তা ছাড়িয়া পার্শ্বের সরু পথ ধরিয়া খোরশেদদের বাড়ি আসিয়া উপস্থিত হইলেন। একটা বিপুল শান্তি তখন তাহার চোখে মুখে প্রতিভাত হইতেছিল। আমেনা তখন কোরান পাঠ করিতেছিল। আমেনার মা রায়হানকে স্নেহের স্বরে বসিতে অনুরোধ করিলেন।
রায়হান সালাম করিয়া বিনা ভূমিকায় উঠানের উপর দাঁড়াইয়া ধীর প্রশান্ত স্বারে কহিলেন–“চাচিজান! আমেনাকেই বিয়ে করবো”।
আমেনা তখন রায়হানের পার্শ্বে আসিয়া দাঁড়াইয়াছিল-সহসা সে মাটির উপর বসিয়া পড়িল।
আমেনার মা কথা কহিতে পারিরেন না–তিনি কাঁদিয়া ফেলিলেন।
রায়হান আমেনার অশ্রুসিক্ত হাতখানি হাতে লইয়া কহিলেন–“আমেনা, তুমি সজ্জিতা হও–আজ রাত্রেই আমার সঙ্গে তোমার বিয়ে হবে–দুজন অন্তরঙ্গ বন্ধু এবং করিমাকে আমি ডেকে আনি।”
রায়হান বাহির হইয়া গেলেন।
.
চতুশ্চত্বারিংশ পরিচ্ছেদ
চার বৎসর অতীত হইয়া গিয়াছিল। খোরশেদ এসলামপুরে বদলি হইয়াছে। ইহারি মধ্যে স্থানীয় জমিদারদের বাড়িতে এক কেলেঙ্কারী হইয়া গিয়াছে। জাহানপুরের যোগেন্দ্র বাবুরা। বহুঁকালের বড় লোক এবং লোকে বলে বনিয়াদি বংশ।
যোগেন্দ্র বাবুর সাত মেয়ে-মেয়েদের বিবাহে তিনি সর্বস্বান্ত হইয়াছেন। রূপে মনোহরা হইলেও বিনা অর্থে তাহাদের একজনেরও সদগতি হয় নাই।
একটি মোকদ্দমায় তাহার বহু হাজার টাকা ব্যয় হইয়া গিয়াছিল। তার পরেই হইয়াছিল তাহার ছোট মেয়ের বিবাহ। বিবাহের দিনই জামাই শ্বশুরের দুরবস্থার পরিচয় পাইয়া মুরুব্বীদের আদেশে ঐ যে চলিয়া গিয়াছিলেন, চার বৎসরের ভিতর আর ফেরেন নাই।
যোগেন্দ্রবাবু বৈবাহিকের নীচতা ও সঙ্কীর্ণতার উপর ক্রুদ্ধ হইয়া ভিতরে জ্বলিয়া পুড়িয়া মরিলেও অর্থ দিয়া কিংবা ক্ষমা চাহিয়া জামাইকে ফিরাইয়া আনেন নাই।
কনিষ্ঠা মেয়ে যামিনীর বয়স ১৮ বৎসর। বিবাহের পর সে স্বামীকে একদিনও আদর সোহাগ জানাইতে পারে নাই। জমিদার বাড়ি বলিয়া কেউ কোনো কথা বলিতে সাহস পাইত না। একেবারে অসংযত বাতাসের মতো সর্বত্র সে খেলিয়া বেড়াইত। চাকর, আমলা, নফর কেউ তাহার সরল আলাপ ও হাসি হইতে বঞ্চিত হইত না।
জমিদার বাড়িতে একজন মুসলমান পেয়াদা ছিল। খোরশেদ আসবার পর সহসা একদিন থানায় সংবাদ আসিল, এই পেয়াদাকে জমিদারেরা হত্যা করিয়া নিকটস্থ দিঘিতে ফেলিয়া দিয়াছেন। কারণ কী তাহা অনেকে অনুমান করিতে প্রয়াস পাইল।
খোরশেদ বিশজন সিপাই পঞ্চাশজন চৌকিদার লইয়া দিঘি পরিষ্কার করিতে প্রবৃত্ত হইল। পেয়াদার মা খোরশেদের পা জড়াইয়া ধরিয়া যাহা বলিল তাহাতে জমিদারদের উপর সমস্ত দোষ গড়াইল।
উদ্ধারের পর দেখা গেল, মৃতদেহের শিরায় শিরায় লৌহশলাকা বিদ্ধ করা হইয়াছে। তাহার চোখ তুলিয়া ফেলা হইয়াছিল এবং জিহ্বাও অতি নিষ্ঠুরভাবে কাটিয়া ফেলা হইয়াছিল।
যোগেন্দ্রবাবুর বাড়িতে তদারক হইল এবং ফলে যাহা যাহা ঘটিল তাহাতে যোগেন্দ্রবাবু বিপন্ন হইয়া পড়িলেন।
.
প্রায় বার হাজার টাকা ঘুষ গ্রহণ করিয়াও খোরশেদ মুসলমান পেয়াদার প্রতি হিন্দুদের অত্যাচারের প্রতিশোধ লইতে বদ্ধপরিকর হইল!
জমিদাররাও খোরশেদকে গোপনে হত্যা করিতে ইচ্ছা করিল।