মেয়েকে বলিলেন–“বাক্সের ভিতর ধোয়া ন্যাকড়া আছে, বের করে আন, তোমার ভাইকে দিয়ে বেঁধে লও।”
রায়হান ন্যাকড়া দিয়া আমেনার আঙুলটি বাঁধিয়া পানিপট্টি করিয়া দিলেন। আমেনার মা ঘরের মধ্যে যাইয়া কতকগুলি সূতা লইয়া নাড়াচাড়া করিতে লাগিলেন।
রায়হান বলিলেন–“করিমা বুবুর সঙ্গে আজ কদিন দেখা হয় না। তিনি আজ এসেছিলেন?”
আমেনা কহিল–“সারা বিকেলবেলা তিনি এখানে কাটিয়েছেন।”
“তোমার জামাগুলি নিয়ে এস। কতদূর অগ্রসর হয়েছে দেখি।”
আমেনা তার হাতের ছাটা তৈরি জামাগুলি লইয়া আসিল। রায়হান দেখিলেন সেগুলি চমৎকার হইয়াছে–কোথায়ও একটু গলদ নাই।
রায়হান আমেনার মাকে ডাকিয়া কহিলেন–“চাচিজান, আমেনা চমৎকার জামা তৈরি করেছে। এমন সেলাইয়ের দাম প্রত্যেক জামাতে এক টাকার কম নয়।”
থালায় কতগুলি গুড়ের মুড়কি এবং কয়েকটা নাড় আনিয়া আমেনার মা রায়হানের সম্মুখে রাখিয়া কহিলেন–“আজ কতগুলি মুড়কি তৈরি করেছি–তুমি দুটো মুখে দাও।”
তারপর কহিলেন–“আমেনা যে চমৎকার সেলাই শিখেছে সে তোমারই অনুগ্রহে।”
রায়হান হাসিয়া কহিলেন–“বেশ! আমারই অনুগ্রহে! ঐ কথা বলবার দরকার কী? আমি কি আপনার পর?”
আমেনার মা বলিলেন–“পর নয় বাপ! পুত্রের চেয়েও আপন।”
তসবিহ টিপিতে টিপিতে তিনি আবার বলিলেন–“শুনলাম তোমার বিয়ে ঠিক হয়েছে। বড় খুশি হয়েছি। বেশ বিয়ে! শুনলাম মেয়ে দেখতে পরীর মতো–বেশ মানাবে। আমি নিজে সে মেয়েকে দেখেছি।”
রায়হানের কণ্ঠ অকস্মাৎ শুষ্ক হইয়া গেল।
আমেনা সহজ কণ্ঠে কহিল–“সকলের চেয়ে বেশি আনন্দ আমার।”
মায়ের দিকে মুখ ফিরাইয়া জিজ্ঞাসা করিল–“বিয়ে হবার কদিন বাকি আছে মা?”
মা বলিলেন–“আগামী মাসেই দুই তারিখ।”
আমেনা কহিল–“আমার ইচ্ছে করে বিবাহের দিন ভাবিকে একজোড়া সোনার বালা উপহার দেই। আমার বালাগুলি যে গিল্টি করা–ক্যামিকেল সোনা।”
মা বলিলেন–“আমার সোনার বালা আছে–তাই দিও।”
রায়হান খানিক পানি খাইয়া জড়িত কণ্ঠে কহিল–“তোমার সেই গিল্টি করা বালাই তুমি উপহার দিও–সোনার বালায় কাজ নেই।” তাড়াতাড়ি চাচিকে সালাম করিয়া রায়হান বাহির হইয়া পড়িলেন।
আমেনার কথাগুলি কঠিন বেদনায় রায়হানের বুকের ভিতর বাজিতেছিল। কতখানি দুঃখকে জয় করিয়া আমেনা তাহাকে এই প্রীতির কথা বলিল। রায়হান ভাবিলেন–তিনি ছোট। হয়তো তার বেদনাবোধ ও সহৃদয়তার কোনো মূল্য নাই।
সেই গাছের নিচে–যেখানে তার একদিন দুপুরবেলা নগেন ঘোষের সঙ্গে কথা হইয়াছিল, রায়হান আঁধারে যাইয়া বসিলেন। নীলাকাশে অনন্ত নক্ষত্র দেখা যাইতেছিল। চিন্তাক্লিষ্ট হৃদয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা অতিবাহিত হইয়া গেল।
সারারাত্রি রায়হান সেখানে বসিয়া কাটাইলেন। পূর্বাকাশ যখন ঈষৎ শুভ্র হইয়া উঠিল তখন তিনি চমকিত হইয়া উঠিয়া বাড়ির দিকে গমন করিলেন।
পিতা তখন বৈঠকখানায় নামাজ পড়িতেছিলেন। রায়হানকে জিজ্ঞাসা করিলেন–রাত্রে কোথায় ছিলে বাপ?
রায়হান কহিলেন–দোকানেই ছিলাম। তারপর পিতার জায়নামাজের কাছে অগ্রসর হইয়া আড়ষ্ট কণ্ঠে বাম হাতে ললাট ঢাকিয়া কহিলেন–“আব্বা! আমি এখন বিয়ে করতে চাই নে। আমায় মাফ করুন!”
পিতা মৃদু হাসিয়া বলিলেন–“পাগল আর কি!”
.
ত্ৰিশ্চত্বারিংশ পরিচ্ছেদ
বিবাহের আয়োজন চলিতেছিল। খাসি কেনা, হলুদ কোটা মেয়েদের আনন্দ-উৎসব পূর্ণমাত্রায় আরম্ভ হইয়া গিয়াছিল।
মেয়েদের আনন্দ-উৎসবের প্রসঙ্গে রায়হানের হৃদয়ও অধিকতর ক্লিষ্ট হইয়া পড়িতেছিল।
একদিন আমেনা অশ্রুসিক্ত চোখে রায়হানের পায়ের কাছে করুণ কণ্ঠে জিজ্ঞাসা করিয়াছিল–“গুরু! আমার চরিত্র সম্বন্ধে কেউ সন্দেহ পোষণ করে কি?”
রায়হান দৃঢ়কণ্ঠে উত্তর করিয়াছিলেন–“না।”
আমেনা আবার বলিয়াছিল–“এখন থেকে আমার জীবনের কোনো মূল্য নাই। সংসারের অবহেলা ও কৃপায় আমাকে বেঁচে থাকতে হবেজিজ্ঞাসা করি, এর জন্য দায়ী কে?”
রায়হান কোনো উত্তর দেন নাই!
আমেনা আবার জিজ্ঞাসা করিয়াছিল–“মানুষ মানুষকে কী দেখিয়া শ্রদ্ধা করে? মানুষের আদর মানুষের কাছে কীসে হয়?”
রায়হান বলিয়াছিলেন–“মহত্ত্বে, পুণ্যে ও আত্মার নির্মলতায়!”
আমেনা উত্তর করিয়াছিলেন–“আমার কি তাহা নাই?”
রায়হান বলিয়াছিলেন–“আছে।”
আমেনা আবার জিজ্ঞাসা করিয়াছিলেন–“জগৎ কি তাহা বিশ্বাস করে?”
রায়হান বলিয়াছিলেন–“আমি তাহা বিশ্বাস করি।”
আমেনা শান্ত আবেগে কহিয়াছিল–“তা হলে জীবনে আমার কোনো দুঃখ নাই। ছাত্রের কাছে গুরুর বিশ্বাস ও শ্রদ্ধাই ঢের।”
রায়হানের প্রার্থনার কোনো মূল্য হয় নাই। পিতা পুত্রের কথার উপর কোনো মূল্যই স্থাপন করেন নাই।
বিবাহার আর তিন দিন মাত্র বাকি। মেয়েরা উৎসব করিয়া দুপুর বেলা রায়হানের গায়ে হলুদ দিতেছিল। পিতা উৎসাহে-আনন্দে এদিক-ওদিক ঘুরিয়া বেড়াইতেছিলেন।
চাচি পাড়ার স্ত্রীলোকদিগেকে দাবায় বসিয়া পান দিতেছিলেন এবং কন্যার রূপ লাবণ্যের কাহিনী কহিতেছিলেন।
একটা জড় পদার্থের মতো রায়হান মেয়েদের ইচ্ছানুযায়ী এখানে-ওখানে নীত হইতেছিলেন। বিবাহের কালে সকল ছেলেই লাজুক ও মৌন হয়ে থাকে তা সবাই জানে।
রায়হানের মুখ বন্ধ হইয়া গিয়াছিল–সরমে নয়, সীমাহীন বেদনায়। উল্লাস কোলাহল তাহার মনুষ্যত্বের প্রতি একটা উপহাস বলিয়াই তাহার মনে মনে হইতেছিল।