রায়হান মাঝে মাঝে ভাবে, এই দুঃখিনী বালিকাটির জীবনের বেদনা ও অপমানের অবসান কোথায়? তার নিজের সহৃদয়তা ও বেদনাবোধের ভিতর হয়তো কোনো গলদ রহিয়া যাইতেছে।
ঊষার কিরণ সমস্ত মাঠ ও পথকে আলোক ও গৌরবে ভরিয়া দিয়াছিল। নীল আকাশে সে আলোক, গৌরব, উল্লাস ও আনন্দে লক্ষমুখে ছুটিতেছিল।
রায়হানের পিতা দোকান-ঘরে প্রবেশ করিলেন। রায়হান সসম্মানে চেয়ার ছাড়িয়া উঠিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন–“কী আব্বা? কোনো জরুরি কথা আছে নাকি?”
রায়হানের বাপ দোকানে বড় আসিতেন না। দোকানের সমস্ত কাজ রায়হানই করিতেন। বৃদ্ধ সাংসারিক কাজের কোনো ধার ধারিতেন না। টাকা পয়সার প্রয়োজন। হইলে পুত্রের নিকট হইতে চাহিয়া লইতেন। দুটি খাওয়া, পাঁচবার মসজিদে যাওয়া এবং বৈঠকখানায় শুয়ে থাকাই ছিল তাঁহার কাজ।
সকালবেলা পিতার আকস্মিক উপস্থিতিতে রায়হান একটু বিস্মিত হইলেন।
পিতা বলিলেন–“একটা বিশেষ কথা আছে বাপ। একা একা দোকানে তোমার সঙ্গে আলোচনা করবো।”
বৃদ্ধ চেয়ার টানিয়া লইয়া কহিলেন–“হুঁকোর জল বদলিয়ে একটু তামাক দেও তো বাপ।”
রায়হান আলবোলার জল বদলাইয়া তামাকে টিকা বসাইয়া পিতার সম্মুখে টেবিলের উপর রাখিলেন।
তামাক টানিতে টানিতে কেরোসিন-বাক্সের প্রকাণ্ড গাদার দিকে চাহিয়া পিতা জিজ্ঞাসা করিলেন–“কয় বাক্স তেল আছে?”
রায়হান বলিলেন–“প্রায় দুশো বাক্স।” সুজির বস্তাগুলির দিকে চাহিয়া রায়হান বলিলেন, “সুজি বাবত প্রায় ১ টাকা লোকসান হবে। জানি না, কী করে বস্তার ভিতর বালি ঢুকে সুজিগুলি পয়মাল করে ফেলেছে। ওগুলি একেবারে ফেলে দিতে হবে।”
বৃদ্ধ বলিলেন–“সুজির ভেতরে যে বালি ঢুকেছে একথা কাউকে বলো না; কে তোমার শুনতে আসবে?”
রায়হান কথা না বলিয়া চুপ করিয়া রহিলেন।
বৃদ্ধ বলিলেন–“পীর সাহেব এসেছিলেন। তিনি তাঁর কন্যাকে তোমার হাতে দিতে চান। যা স্বপ্নেও ভাবি নাই তাই হতে যাচ্ছে।”
রায়হান জিজ্ঞাসা করিলেন–“কোন্ পীর সাহেব?”
“কুসুমপুরের বড় পীর সাহেব। দেশের মধ্যে যার শ্রেষ্ঠ আসন। আমাদের দেশের কারো সঙ্গে যিনি সম্বন্ধ করেন না। দিন আমি ঠিক করে ফেলেছি। আগামী মাসের দুই তারিখ।”
একটু থামিয়া কহিলেন–“একই মেয়ে, প্রচুর সম্পত্তি লাভ হবারও সম্ভাবনা আছে”। অতঃপর রায়হানকে দোকান বন্ধ করিয়া বাড়ি যাইতে বলিয়া বৃদ্ধ নিষ্ক্রান্ত হইলেন।
এই সম্মান ও সম্পদের সংবাদ রায়হানের ভালো লাগিল না। চেয়ারে বসিয়া রায়হান দুয়ারের পথে আকাশের দিকে চাহিয়া রহিলেন।
আমেনার সম্মুখে এই সম্মান ও সম্পদ মানিয়া লইতে রায়হানের কাছে নিতান্ত বিশ্রী বলিয়া বোধ হইতে লাগিল। আমেনার তাহার উপর বিশেষ কি দাবি ছিল? কিছু না। তবুও রায়হান সঙ্কোচে, ব্যথায় অস্পষ্ট স্বপ্নস্বরে বলিয়া উঠিলেন–এই নিরপরাধিনী বালিকার দুঃখ-অপমানের সম্মুখে কোনো স্বচ্ছন্দতা গ্রহণ করিতে পারিতেছি না।
.
দ্বিত্বারিংশ পরিচ্ছেদ
কয়েকদিন চিন্তায়-চিন্তায় কাটিয়া গেল–তবে কি পিতাকে বলিতে হইবে বিবাহের কথা এখন থাক? রায়হান ভাবিলে, পিতা হয়তো তাহাতে অনেকখানি রুষ্ট হইবেন। পিতার জীবনের অনেকখানি আনন্দ হয়তো ইহার মধ্যে নিবন্ধ আছে। সন্তানের কি পিতাকে আনন্দ দেওয়াই জীবনের কর্তব্য নহে?
অকস্মাৎ এত বড় একটা দুর্ঘটনার মধ্যে পড়িতে হইবে রায়হান ইহা ভাবিয়া উঠিতে পারেন নাই। কয়েকদিন ধরিয়া রায়হান বিদ্যালয়ে কিংবা আমেনার কাছেও যান না।
মন তার বড় অবনত হইয়া পড়িয়াছে। একটা কঠিন অস্বস্তি তাহাকে ব্ৰিত করিয়া তুলিয়াছে।
পিতাকে আনন্দ দেওয়া তার কর্তব্য কিন্তু তাই বলিয়া সে তাহার স্বভাব ও আত্মার ধর্মকে অস্বীকার করিতে পারে না–তাতে যে তার মৃত্যু–তার জীবনকে একেবারে মিথ্যা করিয়া দেওয়া। জীবনের স্বপ্ন ও আকর্ষণকে চূর্ণ করিয়া কে কবে বাচিয়া থাকিতে পারে? তার পিতা কি একথা বোঝেন? সে সম্মান-সম্পদ দিয়া কী করিবে?–যদি তাতে তার জীবনের স্বপ্ন আকর্ষণ মাটি হইয়া যায়! আমেনার সম্মুখে সে কোনো স্বচ্ছন্দতা মানিয়া লইতে পারে না–অসম্ভব!
মানুষের দুঃখ বেদনা প্রাণে প্রাণে অনুভব করাতেই তার জীবনের আনন্দ। মানুষের দুঃখের মীমাংসা করাতেই তার জীবনের সার্থকতা। সুখ দিয়া কী করিবে? স্বার্থপর সুখের সঙ্গে তার কোনো সম্বন্ধ নাই। মানুষকে ভুলিয়া সে কোনো সুখ চান না। পরের জন্য দাঃখ যদি ভোগ করিতে হয়, যদি তার জীবন কন্টকময় হয় তাতে তার বিরক্তি নাই;–তাতেই তার গৌরব; সেই গৌরবের সন্ধান করাই তার উদ্দেশ্য।
সন্ধ্যার আগে পাইকারদিগকে পঞ্চাশ মণ লবণ মাপিয়া দিয়া রায়হান খোরশেদের বাড়ির দিকে চলিলেন।
দুয়ারে দাঁড়াইয়া ছাচা আঙুল লইয়া আমেনা দাঁড়াইয়াছিল। মা নামাজ পড়িতেছিলেন। রায়হান আগ্রহে জিজ্ঞাসা করিলেন–“আঙুল কী করে ভেঙ্গেছে?”
কথার উত্তর না দিয়া ঘরের বাতি জ্বালিয়া পাটি পাতিয়া আমেনা রায়হানকে বসিতে অনুরোধ করিল।
রায়হান আবার জিজ্ঞাসা করিলেন, “হাত ছেঁচেছে কেমন করে?”
আমেনা কহিল–“ঢেঁকিতে।”
রায়হান বলিলেন–“একখানা ঘেঁড়া ন্যাকড়া নিয়ে এস; আঙুল বেঁধে পানিপট্টি করে দি, নইলে ব্যথা বাড়বে।”
ততক্ষণে আমেনার মা নামাজ সারিয়া উঠিয়াছেন। তিনি বলিলেন–“বাবা আঙুলটা একেবারে ছেচে গিয়েছে”।